স্বাধীনতা আমাদের শক্তি ড. মো. আজহারুল ইসলাম

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমরা গর্বিত জাতি আজ স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী পালন করছি। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশের সকল মানুষের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আর স্বাধীনতা দিবস প্রেরণা যোগায় নিষ্ঠার পথে নির্ভীক যোদ্ধা হওয়ার। দিনটি শুধু একটি দিবস হিসেবে নয়, এর বর্ণচ্ছটায় বদলে যায় জীবনের গতিপথ, সাহস যোগায় নতুন শপথ নেয়ার। আর এ কারণেই স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য এত বেশি।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়৷ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অসংখ্য বলিদানের পর আসে স্বাধীনতা, হার মানে পাকিস্তানি বাহিনী৷ বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন এক দেশের জন্ম হয়৷ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর খুব কম জাতিই আছে, যারা আমাদের মত এত আত্নত্যাগ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

মাতৃভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রæয়ারির সংগ্রাম-আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রায়, ১৯৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ১৯৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষণা, ১৯৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ১৯৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এসেছে আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর মূল কাজ স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন একাত্তরেই। কিন্তু এ লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশকে অভূতপূর্ব ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যার ফলে দেশ পুনর্গঠন এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন কাজে পরিণত হয়। এর মধ্যেও সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো মৌলিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশ সদস্যপদ পেয়েছিল। তখনো বাকি ছিল অর্থনৈতিকভাবে দেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো বা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। জনপ্রশাসনকে গণমুখী ও দক্ষ ভিত্তিদান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এগুলোর বিস্তিতি ঘটানোর কাজও আরব্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনের কাজ অসমাপ্ত রেখে নিহত হলেন।

তারপর দীর্ঘ ২০ বছরের বৈরী শাসন সত্তে¡ও বাংলাদেশ যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সত্যিকারের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে, এর কারণ এত বাধাবিপত্তি, নির্যাতন-বিপর্যয় সত্তে¦ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সংগ্রামের হাল ছাড়েনি। শক্ত হাতে হাল ধরেছেন তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর বড় অবদান হলো ছয় দফা পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে তো নির্ভর করতে হয়েছে সংগঠনের ওপর এবং এভাবে আওয়ামী লীগও গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’ সরকারের রুপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে।

সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ।

আওয়ামীলীগের হাত ধরে সরকারের দুর্বার গতিতে বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫০ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যু, গড় আয়ু, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতি দৃশ্যমান। একযুগ পূর্তিতে সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে গত ১২ বছরে দেশের যেমন উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি প্রতিটি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে বহুলাংশে, বাংলাদেশে এখন ছেঁড়া কাপড় পরা, খালি পায়ে মানুষ দেখা যায় না, কবিতায় কুঁড়েঘর আছে, বাস্তবে নেই। ১২ বছর আগে আমরা বলতাম ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বিনির্মাণ করব। জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে ইতোমধ্যে ক্ষুধাকে জয় করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রায়, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নীত মধ্যম আয়ের দেশে। সব সূচকে আমরা অনেক আগেই পাকিস্তানকে ও বেশ অনেক সূচকে ভারতকেও অতিক্রম করেছি।

করোনাকালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। সব দেশের রপ্তানি কমলেও আগের বছরের তুলনায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৫ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার, জ্বালানি চাহিদাও বেড়েছে, যা অগ্রগতির প্রতীক। সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও বাংলাদেশ করোনা মহামারি মোকাবিলায় উপমহাদেশে সবচেয়ে সক্ষম এবং পৃথিবীতে ২০তম।

লেখক: প্রফেসর, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ সংবাদ