ইসলামিক বিধানে মানবজীবনে স্রষ্টা ও সৃষ্টির হকের (অধিকার) গুরুত্ব

মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী-“হক আরবী শব্দ এর শাব্দিক বাংলায় অর্থ হলো অধিকার। ইসলামিক বিধানে মানবজীবনে স্রষ্টা ও সৃষ্টির হকের (অধিকার) গুরুত্ব” উল্লেখযোগ্য। হক সাধারণত দুই প্রকারের (এক) হক্কুল্লাহ, আল্লাহর হক (স্রষ্টার অধিকার)। অর্থাৎ সৃষ্টি (মানুষ) স্রষ্টার (আল্লাহ) কৃতজ্ঞতায় আনুগত্যমূলক আত্মিক এবং বাহ্যিকভাবে স্রষ্টার অধিকার নিজের মধ্যে দায়িত্বশীলতার সহিত প্রতিষ্ঠিত বা কায়েম করা। যেমন প্রাপ্ত বয়স হলে সময়ের গুরুত্বে দিয়ে মুসলিম নর ও নারী সময়মত নামাজ আদায়, রমযানে রোজা (সিয়াম) পালন, মালে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত আদায়সহ হজ্ব ও কোরবানি ইত্যাদি ইবাদত করা। (দুই) হক্কুল ইবাদ বান্দার হক (সৃষ্টির অধিকার)। অর্থাৎ বান্দার হক (সৃষ্টির অধিকার) বলতে সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির সম্পৃক্ত হকগুলো কোরআন—সুন্নাহর বিধানের আলোকে ন্যায্যতাভিত্তিক (ইনসাফ) নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বা কায়েম করা। যেমন পারস্পরিক টাকা—পয়সার লেনদেন, টাকা—পয়সার আমানত, অংশীদারের অংশ সঠিকভাবে আদায়, কথার আমানত, পারস্পরিক ইজ্জত—সম্মান রক্ষাসহ ইত্যাদি নেক (ভালো) কাজ। জানা থাকা দরকার যে এগুলোও কিন্তু ইবাদত। রাসূলে কারীম রাউফুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে মানবজীবন হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

মানুষের জীবনে মানুষ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাদের সময় অতিবাহিত করে। আর দুনিয়াতে মানুষের অন্যতম দায়িত্ব হলো যথাযথভাবে আল্লাহর তাআলার ইবাদত—বন্দেগি করা। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না, তাদের যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ (সুরা আন নিসা : ৩৬)।কোরআনুল মাজিদে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সঙ্গে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না, আর এছাড়া অন্যান্য পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল অবশ্যই সে চরম ভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো।’ (সুরা আন—নিসা : ১১৬)। তবে স্রষ্টার অধিকার লঙ্ঘন করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। এগুলোকে বলা হয় হক্কুল্লাহ (সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার অধিকার)। মানুষের কাজ হলো পৃথিবীতে প্রতিটি কাজই বৈধ পন্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে তার হুকুম—আহকাম অনুসারে নাফরমানি ও অবাধ্যতামূলক কাজ থেকে বিরত থাকা। তখন সে কাজ শুধু দুনিয়ার প্রয়োজনেই সম্পন্ন হবে না পরকালের সম্বল হিসেবেও পরিগণিত হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্যায়, অবাধ্যতা ও নাফরমানিমূলক কাজের কারণে পরীক্ষামূলক অনেক সময় আজাব বা শাস্তি দিয়ে থাকেন। তা কিন্তু বান্দার প্রতি আল্লাহর এ ধরণের শাস্তি জুলুম নয় প্রতিফল স্বরূপ। কারো যদি আজাব বা শাস্তির কোনো কিছু অনুভূত হয় তাদের উচিত অন্যায় কাজ থেকে ফিরে আসা এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়া।

হক্কুল্লাহর পরপরেই হক্কুল ইবাদে মাতা—পিতার হক সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন— মা সবার আগে সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার। এভাবে তিনি পর পর তিনবার জিজ্ঞাসার জবাবে মাকে সর্বোত্তম হকদার বলে চতুর্থবার পিতাকে হকদার হিসেবে উল্লেখ করেন। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ) মানুষের অধিকার হলো, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসা, সবার সেবা করা, সাহায্য—সহযোগিতা করা। একজন মুসলিম অপর মুসলিমের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র যে হক আদায় করতে হয়, তা হচ্ছে সালাম বিনিময় করা এমনকি অন্যধর্ম অনুসারীদের সাথেও ইসলামি বিধানের নিমিত্তে সালামের আদানপ্রদান করা। সালাম বিনিময় শুধু একজন মুসলিমের সঙ্গে অপর মুসলিমের একব্যক্তির সাথে অপরব্যক্তির হক আদায় নয়, এর মাধ্যমে সম্প্রীতি বাড়ে, শত্রুতা কমে। পরস্পরের জন্য কল্যাণের দোয়া (প্রার্থনা) হয়। পরিবার, সমাজ ও মানবসেবাও হলো হাক্কুল ইবাদের অন্যতম দিক। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, নবী করিম সাঃ বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ—দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টির হাত বাড়িয়ে দেন।’ (সহিহ্ মুসলিম : ২৫৬৬)। অভাবী মানুষকে সহায়তা করা, তাদের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, বস্ত্রহীনকে পোশাক—আশাক দিয়ে সহায়তা করাও সওয়াবের কাজ। হাদিসে আরো বর্ণনা আছে যে, হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাঃ বলেন, নবী করিম সাঃ ফরমান ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে বস্ত্রহীনতায় বস্ত্র দিলে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরাবেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৮৩৫)। হাদিসে এছাড়াও আরো বর্ণিত আছে ‘যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন, খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন, পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১৭৫২)। অন্নহীনকে খাবার দেওয়াও হাক্কুল ইবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হাদিসে হক প্রসঙ্গে এও ইরশাত হয়েছে, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ—খবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ (সহিহ্ বোখারি : ২৪১৭)। হাদিসে হজরত রাসূলে রাব্বী সাঃ ক্ষুধার্তকে খাবার দান করতে কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা ভিক্ষুক (ক্ষুধার্তকে) কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটি খুর হলেও।’ (আহমাদ : ১৬৬৯৯)। সাধারণত এগুলোকে বলা হয় হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক (সৃষ্টির প্রতি সৃষ্টির অধিকার)। ইসলামের বিধান হলো— যে পর্যন্ত এক বান্দা অন্য বান্দার হক (যার হক সে নষ্ট করেছে) যথাযথভাবে আদায় না করবে বা বান্দার থেকে ক্ষমা চেয়ে না নেবে সে পর্যন্ত আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না। একজন মানুষের কাছে অন্য মানুষের টাকা—পয়সা থেকে নিয়ে তার ইজ্জত—আব্রুসহ সবকিছুই আমনত। তা রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষ বিশেষ করে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। কারও নামে মিথ্যা রটানো, কিংবা কারও ইজ্জত—আব্রু নষ্ট করে তাকে কষ্ট দেওয়ার দ্বারা মূলত তার হক নষ্ট করা হয়।

এ বিষয়ে শ্বাশত গ্রন্থ কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাৎ করেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। যারা বিনা অপরাধে মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (সূরা আহজাব, আয়াত ৫৭, ৫৮)। তৎকালীন যুগে মুনাফিকরা বিভিন্নভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মু’মিন মুসলমানদের কষ্ট দিয়ে তাদের হক নষ্ট করত। আলোচ্য আয়াত দুটিতে আল্লাহ রসুল ও মু’মিন নারী—পুরুষদের কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। যারা এই হুকুমকে মানবে তারা সফলকাম হবে, আর যারা মানবে না তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে মহাশাস্তি রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মুসলমান তো সে যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকবে। ’ অর্থাৎ কোনো মুসলমান তার হাতের ব্যবহার ও জবানের ভাষা দ্বারা কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। শুধু মানুষ কেন? কোনো প্রাণীকেও বিনা অপরাধে কষ্ট দেওয়ার বিধান ইসলামে নেই। এ সম্পর্কে ইবনে হিব্বানে অন্য একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিও না, তাদের লজ্জা দিও না এবং তাদের দোষ—ত্রুটি খুঁজো না। ’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো মুসলিমকে কষ্ট দিল, সে মূলত আমাকেই কষ্ট দিল, আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে মূলত আল্লাহকে কষ্ট দিল, অর্থাৎ আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করল।’ হাদিসের নির্ভরযোগ্য কিতাব মুসলিম ২৫৮১ ও তিরমিজির ২৪১৮ নম্বর হাদিসে দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে (আসল) নিঃস্ব তো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন অনেক নামাজ, রোজা ও যাকাতের নেকি নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু এর সঙ্গে সে এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে। কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারও মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে, কারও রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর অমুক অমুক (অত্যাচারিত) ব্যক্তিকে তার নেকিগুলো দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকি অন্যদের দাবি পূরণ করার আগেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের পাপরাশি নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে। অতঃপর (অন্যদের পাপের বোঝার কারণে) তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

প্রিয় বন্ধুরা, হাদিসসমূহের প্রতি লক্ষ্য করুন এবং বুঝুন কাউকে কষ্ট দেয়া, কারও ইজ্জত—আব্রু নষ্ট করা কত বড় অপরাধ! মু’মিনের দায়িত্ব শুধু নামাজ, রোজা ও হজ্জ পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেসব ইবাদত সরাসরি আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় না অপরের অর্থাৎ প্রতিবেশীর কল্যাণার্থে করা হয়— তা হলো সমাজসেবামূলক সওয়াবের কাজ। কোরআনুল মাজিদে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান আনে এবং নেক কাজ করে, আমি নিশ্চয়ই তাদের সেসব ত্রুটিগুলো দূর করে দেবো এবং তারা যেসব নেক আমল করে আমি তাদের সেসব কর্মের উত্তম ফল দেবো (সূরা আনকাবুত : আয়াত—৭)। হাসি—তামাশার ছলে, অনেকেই অনেক সময় কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট দেয়, এমনকি অন্যের নামে মিথ্যা অপবাদ রটাতে থাকে, যা ইসলামিক বিধানের অমার্জনীয় অপরাধ ও কঠিন গুনাহের কাজ। ইসলামে আল্লাহ হকের চেয়েও বান্দার হকের ব্যাপকতা অনেক। মনে রাখতে হবে একে অন্যের ইজ্জত—আব্রু রক্ষা করা হক (অধিকার)। এগুলোর প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। পার্থিব জীবন ক্ষণিকের হাসি—ঠাট্টা ও রসিকতার প্রতিফলন কিন্তু কঠিন শাস্তি। তাই আসুন উল্লেখিত বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে উভয় জগতে নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় আমরা সকলেই এখন থেকে সচেতন হই, যেন আমার—আপনার কথার দ্বারা অন্য কেউ কষ্ট না পায়, আর যদি কখনো কাউকে কষ্ট দিয়েই ফেলি তাহলে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিই।

সর্বশেষ সংবাদ