ভারতীয় পাসপোর্টধারীদের লাগেজে আসছে ভারতীয় পণ্য!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে ব্যাপক তৎপর লাগেজ পার্টি। ওই পার্টির কাজ হলো, ভারত থেকে পোশাক, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে তারা এ কাজ করছেন। প্রায় ৫০ জনের অধিক ভারতীয় দম্পতি এভাবে পণ্য নিয়ে আসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) লাগেজ পার্টির একটি চালান আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। রফাদফার মাধ্যমে একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় সাংবাদিকরা এ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কিছুটা পিছু হটেন। তবে শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহানার পর তারা নামকাওয়াস্তে শুল্ক আদায় করে পণ্য বহনকারীদের ছেড়ে দেয়। লাগেজ ব্যাগের সুবিধার বাইরে পৌনে ছয় লাখ টাকার পণ্য আনার কথা উল্লেখ করে ৮৩ হাজার টাকা শুল্ক আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব পণ্য বন্দর এলাকায় থাকেন এমন এক সাংবাদিকের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনিই মূলত চাপ দিয়ে এসব পণ্য ছাড়িয়ে নেন। আরও পড়ুন: মোটরসাইকেল নিভিয়ে দিল মেধাবী দিনারের জীবন এদিকে বন্দর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ধনঞ্জয় দে ও রূপা দে নামে দুই ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাদের কাছে বড় আকারে পাঁচটি ব্যাগ ছিল। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বিষয়টি গোপনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। প্রথমে টালবাহানা করলেও এক পর্যায়ে ব্যাগে কি আছে জানতে চায়। এরই মধ্যে তাদের ব্যাগ তল্লাশি না করতে ছুটে আসেন একটি জাতীয় দৈনিক ও বেসরকারি একটি টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি। সামান্য জরিমানা করা হবে শর্তে ধনঞ্জয়কে দিয়ে ওই সাংবাদিকের সামনে ব্যাগ খোলান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে অন্যান্য স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক কাস্টমস কার্যালয়ে উপস্থিত হন। উপস্থিত হওয়া পরিচয় জানার পর শুরু থেকেই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক পণ্যের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। এ সময় প্রথমে জানানো হয়, ধনঞ্জয়দের বহন করা লাগেজে ৬৫টি থ্রি-পিস অতিরিক্ত পাওয়া গেছে। সাংবাদিকরা এ নিয়ে আপত্তি তুললে তড়িঘড়ি করে আবার ধনঞ্জয়কে দিয়েই ব্যাগের কাপড় গণনা শুরু করান। তখন তিনি মোট ৯৯টি পোশাক অতিরিক্ত বলে জানান। সাংবাদিকেরা আবার চ্যালেঞ্জ করলে পাঁচটি ব্যাগ খুলে প্রায় ২৯৪টি পোশাক পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭০টি থ্রিপিস, ২০৬টি শার্ট, ১৮টি জিন্স প্যান্ট রয়েছে। ব্যাগে একাধিক মদের বোতলও পাওয়া যায়। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, করোনা শুরুর পর থেকে ভারত থেকে এভাবে পণ্য আসা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি বেড়ে যায়। বিশেষ করে কলকাতা থেকে পোশাকসহ কসমেটিকস। এক্ষেত্রে সেখানকার ব্যবসায়ীরা লোক দিয়ে এসব পণ্য পাঠান। এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা- চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্থানীয় চার-পাঁচজন সাংবাদিক এর সঙ্গে জড়িত। কাস্টমসসহ বন্দরের সংশ্লিষ্টদেরকে ম্যানেজ করে তারা অবাধে এসব পণ্য পাচার করছেন। অন্তত ৫০ এর অধিক ভারতীয় দম্পতি এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। বন্দর এলাকার এক সাংবাদিক সরাসরি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার শ্বশুর বাড়ি চট্টগ্রাম এলাকাতে হওয়ায় নিয়মিতই এই ভারতীয় পোশাক জাতীয় পণ্য সেখানে পাঠানো হতো। এ বিষয়ে জানতে চাইলেই ভারতীয় নাগরিক ধনঞ্জয় দে প্রথমে স্থানীয় ওই সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে তার শিখিয়ে দেওয়া রাহুল নামে এক ব্যক্তির নাম মালিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ব্যবসার জন্যই এসব পণ্য দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু পণ্য বহন করার মালিক। আর কখনো বাংলাদেশে আসেনি। আমাকে চট্টগ্রাম যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না। তিনি বলেন, আমার ছবি আপনারা কোথাও দেবেন না। তাহলে মুখ দেখাতে পারব না। এ ব্যাপারে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বলেন, ওই যাত্রী কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে পণ্য নিয়ে যেতে চাইছিলেন। তার ব্যাগ তল্লাশি করে ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে যা পাওয়া গেছে সেগুলোতে শুল্ক ধরা হয়। ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে ঢোকার পথে এ সুবিধা পাবেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন। পরে তিনি একটি নিয়ম উপস্থাপন করেন। সেটিতে বিদেশ ফেরত যাত্রী ব্যাগেজ সুবিধা পাবেন বলে উল্লেখ থাকতে দেখা যায়। এদিকে গত কয়েকদিন আগে লাগেজ পার্টি তৎপরতা সম্পর্কে একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর থেকে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পরে আখাউড়া স্থলবন্দরের কাস্টমস এক্সাইড অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারের কার্যালয় দায়িত্বরত অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হয়। গত সপ্তাহ খানেক আগে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে শাহ্ নোমান সিদ্দিকী যোগদেন। তার যোগদানের পর চক্রের সদস্যরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠে বলে অভিযোগ উঠে এদিকে ভারত থেকে পার্সপোট নিয়ে সে দেশের নাগরিকেরা কাপর, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পণ্য পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠায় বন্দরের বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আখাউড়া স্থলবন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তারা এলসি’র মাধ্যমে এ বন্দর দিয়ে সরকারি কোষাগারে ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করে থাকি। পক্ষান্তরে লাখ-লাখ টাকার সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে লাগেজের মাধ্যমে বড় চালান প্রবেশ করছে। পাঁচটা চালান ছেড়ে দিয়ে দুটি চালানকে জরিমানা করে থাকেন। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছেন। অবিলম্বে এমন চোরাই তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানান। এ ব্যাপারে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমানা আক্তার জানান, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেবলমাত্র লাগেজ পার্টি থেকে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ট্যাক্স আদায় করেছে স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ সংবাদ