ব্রিটিশদের আতঙ্কের আরেক নাম মন্থনার দেবী চৌধুরানী !!!

শাফায়াত সজল, রংপুরের পীরগাছা থেকে ফিরেঃ দেবী চৌধুরাণী !! ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে যে কয়জন নারী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণী। তিনি ছিলেন তৎকালীন প্রজা আন্দোলনের অন্যতম। তার দাম্পত্য সঙ্গী নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরী। পিতার নাম ব্রজ্র কিশোর চৌধুরী ও মাতার নাম কাশীশ্বরী দেবী। মন্থনার জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর সাথে তার বিবাহ হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর জমিদারির দায়িত্ব তার উপর এসে পড়ে। তিনি প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। তার সময় রংপুর অঞ্চলের কালেক্টর হয়ে আসেন জনাথন গুডল্যাড এবং তার দেওয়ান নিযুক্ত হন দেবীসিংহ। ব্রিটিশরা দেওয়ান দেবীসিংহ ও তার কর্মচারীদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করেন।
রাজস্ব আদায়ে সময় তাদের অত্যাচারে কৃষক এমনকি জমিদাররাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এছাড়াও সেই সময় ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার বেড়ে যায় এবং তারা জোরপূর্বক উর্বর জমিতে কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করা শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চৌধুরাণী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । আর সেই কারণেই তিনি ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েন। তাকে দমন করার জন্য মীর কাশিমের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সৈন্যবাহিনী পাঠায়। এই যুদ্ধে দেবী চৌধুরানীর সাথে রংপুরের নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং, ভবানী পাঠক এবং দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলের শত শত কৃষক অংশ নেয়। ১৭৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে দেবী চৌধুরাণী জয়লাভ করে। যুদ্ধে ইংরেজ ক্যাপ্টেনসহ অনেকেই নিহত হন এবং মীর কাশিম পিছু হটতে বাধ্য হন। যুদ্ধে জয়লাভের স্থানটি মানুষের কাছে “জয়পুর” নামে পরিচিত।
তার মৃত্যু ১৭৮৩ সালের এপ্রিল মাসে ১লা বৃহস্পতিবার (বর্তমান পীরগাছা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রাম) লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এর নেতৃত্বে একদল ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত এবং নিহত হন। এই যুদ্ধে দেবী চৌধুরাণীর সাথে অন্নদানগর এর জমিদারও নিহত হন। দেবী চৌধুরাণীর পরাজিত স্থানে বাংলা বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার মেলা বসে। যা “নাপাইচন্ডি” মেলা নামে পরিচিত। স্বৃতিচিহ্ন হিসাবে তার নামে রংপুরে রয়েছে দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ, চৌধুরাণী রেলস্টেশন, চৌধুরাণী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চৌধুরানী বাজার । তার খননকৃত বিশাল চৌধুরাণী দিঘি, চন্ডিপুর দিঘি এবং মন্থনার রাজবাড়ি আজো টিকে আছে কালের সাক্ষী বহন করে। দেবী চৌধুরানী ক্ষণজন্মা এক জনহিতৈষী নারী ও তেজস্বী বিপ্লবী। তিনি তার জীবনে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। প্রজা বিদ্রোহের অন্যতম রূপকার দেবী চৌধুরানী এর অবাধ বিচরণস্থল ছিল রংপুরের পীরগাছা। তার রাজবাড়ির পিছনে একটি খাল খনন করেছিলেন যা দিয়ে তিনি গোপন পথে যাতায়াত করতেন। তার বজরা বর্তমান তিস্তা নদীতে চলতো। তিনি কোথায় থাকতেন, কোথায় যেতেন তা ইংরেজরা জানতে পারতো না।
দেবীগঞ্জও তার স্মৃতির এলাকা। করতোয়া, তিস্তা নদী, আত্রাই ও কুড়ুম নদীতে ঘেরা এখানকার ঘন বনাঞ্চলে ব্রিটিশদের সাথে তিনি কয়েক দফা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বিজয়ী হন। তার স্মৃতি থেকেই এর নামকরণ হয় দেবীগঞ্জ। তবে এই নামের পেছনে অন্য একটি মতও আছে। এ জনপদটি পূর্বে হিন্দু-অধ্যুষিত ছিল। কেউ কেউ বলেন, তাদের দেব-দেবীর নাম থেকেই দেবীগঞ্জ নামটি আসতে পারে। ইতিহাস সংরক্ষণ হোক বা না হোক, সময়ে সময়ে দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠকদের মতো বিপ্লবীদের আবির্ভাব হয়েছে, যারা আড়ালে থেকে অসহায় মানুষদের রক্ষার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন জনসাধারণের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং জনসমর্থনের কারণে ইংরেজরা ‘দেবী চৌধুরানী’কে মেয়ে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করলেও শত চেষ্টা করে আটক করতে পারেনি। তবে ইতিহাস অনুসন্ধানী অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখিত প্রফুল্ল নয় বরং ‘দেবী চৌধুরানী’ ছিলেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার জয়দূর্গাদেবী। যিনি ছিলেন শিবুকুণ্ঠি বা বামনপাড়া গ্রামের ব্রজ কিশোর রায় চৌধুরী ও কাশিশ্বরী দেবীর মেয়ে।
তথ্যসূত্রঃ স্থানীয় বাসিন্দা, লেখক, গবেষক, শিক্ষক এবং বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর।

সর্বশেষ সংবাদ