বিজ্ঞানী ও অভিনেতার বন্ধুত্ব

তাঁরা দুজনে ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা জগতের বাসিন্দা। একজন বিজ্ঞানী, মাথা ভর্তি জটিল সব সমীকরণে। অন্যজন কৌতুক অভিনেতা। রুপালি পর্দায় তাঁর প্রতিটি চলাফেরাই দর্শকের অট্টহাসির খোরাক জোগাত। কখনো কখনো হাসি শেষে চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠত, দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে যেত প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ।

অথচ এমন বিপরীত জগতে থেকেও দুজনের মধ্যে জমে উঠেছিল দারুণ এক বন্ধুত্ব। হ্যাঁ, গল্পটা আলবার্ট আইনস্টাইন ও চার্লি চ্যাপলিনের বন্ধুত্ব নিয়ে।

গল্পের শুরুটা ১৯৩০-৩১ সালে। ওই সময় আইনস্টাইন দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আমন্ত্রণে সেবার বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন তিনি।

বিজ্ঞানের জগতে আইনস্টাইন তখন সূর্য। তাঁর খ্যাতির দীপ্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোতে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমাতেন হাজারো ভক্ত। খবরের কাগজওয়ালারা আইনস্টাইনের বলা প্রতিটি শব্দ টুকে নিতেন। বড় বড় বাতিওয়ালা ক্যামেরা জ্বলত শব্দ করে। এমনই এক সময়ে চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা হয় আইনস্টাইনের। তাঁর অভিনয়খ্যাতিও তখন আকাশ ছুঁয়েছে।

১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে আইনস্টাইন আমেরিকা পৌঁছান। কয়েক দিন নিউইয়র্কে থেকেছিলেন তিনি। এরপর যান ক্যালিফোর্নিয়ায়। আইনস্টাইনের সঙ্গে পরিচয় ছিল বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা কোম্পানি ‘ইউনিভার্সাল স্টুডিওস’-এর প্রধান কার্ল ল্যামলের। ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য বিজ্ঞানীকে হলিউডে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ল্যামলে। সিনেমা দেখার কোনো এক মুহূর্তে আইনস্টাইন ল্যামলেকে বলেন, তিনি চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। এরপর ল্যামলে দ্রুতই চ্যাপলিনকে ফোন করেন।

জগদ্বিখ্যাত আইনস্টাইন ও কিংবদন্তি অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। দুজন স্টুডিওতে কিছুক্ষণ ঘোরেন, একসঙ্গে দুপুরের খাবার সেরে নেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে এগোতে থাকে আলাপ। প্রথম আলাপে একে অপরের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা করতেও ছাড়েননি দুজন।

প্রথম দেখায় আইনস্টাইনকে কেমন মনে হয়েছিল চ্যাপলিনের? এই বিষয়ে আত্মজীবনীতে চ্যাপলিন লিখেছেন, আইনস্টাইনকে তাঁর ঘরোয়া ‘আলপাইন জার্মান’দের মতোই লেগেছিল। তবে চমৎকার অনুভূতিসম্পন্ন, হাসিখুশি আর বন্ধুপূর্ণ ছিলেন আলবার্ট। তিনি খুব শান্ত ও ভদ্র। তবে এসব ছাপিয়ে ফুটে উঠেছিল আইনস্টাইনের গভীর ও অনন্য সংবেদনশীল মনের পরিচয়। চ্যাপলিনের ধারণা, এই সংবেদনশীল মনই আইনস্টাইনের অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্যের আধার।

চ্যাপলিনের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ওই সাক্ষাৎকারের কোনো এক মুহূর্তে আইনস্টাইনের স্ত্রী এলসা একটু আড়ালে ডেকে নেন চ্যাপলিনকে। এরপর চ্যাপলিনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ দেখান এলসা। চ্যাপলিন আনন্দের সঙ্গে তাঁদের আমন্ত্রণও জানান। আয়োজন করা হয়েছিল এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের।

প্রথম পরিচয় থেকেই চ্যাপলিন ও আইনস্টাইনের বন্ধুত্ব জমে গিয়েছিল। চ্যাপলিন সে সময় তাঁর মুক্তি পেতে যাওয়া চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইটস (১৯৩১)’-এর প্রথম শো দেখতে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছবিটি দেখতে আইনস্টাইন একেবারে চ্যাপলিন সাজে হাজির হয়েছিলেন। জানা যায়, দুজনকে দেখে দর্শকেরা ব্যাপক উল্লসিত হয়েছিলেন এবং ঘন ঘন অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। এটি দেখে আইনস্টাইন খানিকটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, এই সময়ই নাকি চার্লি চ্যাপলিন সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন। তা হলো, ‘তারা আমাদের দুজনকে দেখেই অভিভূত। তোমাকে দেখে অভিভূত, কারণ তারা কেউই তোমাকে বুঝতে পারে না। আমাকে দেখে অভিভূত, কারণ সবাই আমাকে বোঝে।’ অবশ্য এ ঘটনা ও উক্তি নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে।

আইনস্টাইন ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে ফের ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিলেন। সেবার এই বিজ্ঞানীর সম্মানে চ্যাপলিন একটি ‘ডিনার পার্টি’র আয়োজন করেন। ওই পার্টিতে সেই সময়কার বিখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম র‌্যানডলফ হার্স্টের সঙ্গে আইনস্টাইনের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন চ্যাপলিন। তাঁর আশা ছিল, এই দুজনের সাক্ষাৎ হবে খুব চমকপ্রদ আর বুদ্ধিদীপ্ত। তবে চ্যাপলিনের এই আশা দ্রুতই হতাশায় রূপ নেয়। কী কারণে জানি সেদিন আইনস্টাইন কিছুটা চুপচাপ ছিলেন। বিপরীত দিকেও ছিল একই অবস্থা। হার্স্টও যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। খাবার টেবিলে যেন নেমে এসেছিল অন্তহীন নীরবতা।

ওই ঘটনার পর চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে আইনস্টাইনের বন্ধুত্ব টিকে ছিল কি না, তা অবশ্য আর জানা যায়নি। ১৯৩৩ সালে আইনস্টাইন জার্মান নাগরিকত্ব ছেড়ে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য চলে যান। সেখানে নিউজার্সির প্রিন্সটনে বসবাস শুরু করেন তিনি। চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক নিয়ে এরপর আর কিছু প্রকাশ্যে আসেনি। তবে তাঁদের প্রথম দিককার পরিচয়ের ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল—দুই ক্ষণজন্মা প্রথম পরিচয়েই একে অন্যকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন।

সর্বশেষ সংবাদ