মসজিদে বিস্ফোরণ: কেমন আছেন আমজাদ, কেনান

পোড়া ক্ষত শুকানোর পর দুজনেরই শরীরের এখানে-ওখানে সাদা ছোপ ছোপ দাগ। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে  বাড়িতেও ফিরেছেন আমজাদ আর মোহাম্মদ কেনান । কিন্তু এখনও কানের ব্যথা ভোগাচ্ছে তাদের। সঙ্গে শরীরিক যন্ত্রণাও আছে কিছুটা।

গত ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ যে ৩৭ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল, তার মধ্যে জীবিত তিনজনের দুইজন হচ্ছেন আমজাদ ও কেনান।  বাকি ৩৪ জনই একে একে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

সুস্থ তিজননের মধ্যে ঘটনার তিনদিনই পর ৭ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাশেষে মামুন প্রধান নামের একজন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন।

আর আমজাদ গত ৩০ সেপ্টেম্বর, কেনান ১১ অক্টোবর বাড়ি ফেরেন। দুজনই এখন নারায়ণগঞ্জে আছেন।

দুর্ঘটনায় শ্বাসনালীসহ আমজাদের শরীরের ২৫ এবং কেনানের শরীরের ৩০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। বিস্ফোরণে দুজনেরই কান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনও নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

বিভীষিকাময় সেই রাতের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বেঁচে ফেরা আমজাদ আর কেনান।

ভায়রা ইমরানের সঙ্গে ঘটনার রাতে এশার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসিরহাট গ্রামের আবদুল আহাদের ছেলে আমজাদ (৩৭)। বিস্ফোরণে আহত দুজনকেই হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচেননি ইমরান।

আমজাদ বলেন, “আমার ভায়রা ইমরান ভাইও সেদিন আমার লগে নামাজ পড়তে গেছিল। কয়েক বছর ধইরা আমরা একসাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়ি। যেখানেই যাইতাম একসাথে যাইতাম।”

সেদিনের ঘটনার বলতে গিয়ে আবেড়তাড়িত হয়ে পড়েন তিনি।

“ঘটনার সময় নামাজটা শেষ কইরা আমি আগেই তার জুতা পইরাই বাইরে গেছিলাম, ওজু ঘরে গিয়া দাঁড়াইছি, এর মধ্যেই সব শেষ। দশটা সেকেন্ডও টাইম নেয় নাই, কিছুই বুঝতে পারি নাই কী হইলো!

“তয় এমন অবস্থা থেকে যে বাইচ্চা ফেরত আসছি, সেটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমি হাসপাতালে শুইয়া রোজ মরতে দেখতাম একেকজনেরে, আর ঘুমাইতে গিয়া স্বপ্ন দেখতাম তারা আমারে ডাকে।”

নারায়ণগঞ্জেই শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী এবং পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের এক পোশাক কারখানার গাড়ি চালাতেন। সেখান থেকে তাকে সাময়িকভাবে ছুটি দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমারে ওইখান থেকে ছুটি দিছে। যতদিন না সুস্থ হমু, ততদিন কাজে যাইতে পারমু না।”

অতিরিক্ত ব্যথা এবং ক্ষতের কারণে আমজদের বাম কানের খানিকটা কেটে ফেলতে হয়েছে। কানের চিকিৎসা নিতে নিয়মিত তাকে যেতে বার্ন ইন্সটিটিউটের জরুরি বিভাগে।

আমজাদ বলেন, “কানের ব্যথায় ঘুমানো মুশকিল হইয়া গেছে। ডাক্তার কইছে ওষুধ খাইয়া ব্যথা কমায়ে রাখতে। তার উপর আমার ডায়াবেটিস আছে। শরীরের যন্ত্রণা তো এখনও আছে।”

নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন পটুয়াখালীর চুন্নু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ কেনান (২৪)। দুর্ঘটনার তিন মাস আগেই করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে যান। এরপর কর্মসংস্থানের খোঁজে নারায়ণগঞ্জেই থাকেন তিনি।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কেনান বলেন, “এশার নামাজ পইড়া বাইর হইয়া জুতা পায়ে দিতেছিলাম, এমন সময় পেছন থেইকা আগুনের হলকা আইসা গায়ে লাগে।

“এরপর অজ্ঞান অবস্থাতেই কয়েকজন ধরাধরি কইরা নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়া যায়, কিন্তু ওইখানে চিকিৎসা ভালো না হওয়ায় ঢাকায় নিয়া যায়। বাঁচারই তো কথা ছিল না। উপরওয়ালার ইচ্ছায় এখনও বাইচ্চা আছি, বাসায় আইতে পারছি।”

পরিবার নিয়ে কিভাবে চলছেন, জানতে চাইলে বলেন, “আমার ছোট একটা ছেলে আছে, তিন বছর বয়স। পরিবার আমার উপরই চলত এক সময়। দুর্ঘটনার পর  ছোট ভাই আর বাবার কাছ থেকে সাহায্য নিয়া চিকিৎসা চালাইছি।”

তবে আমজাদ, কেনান দুজনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা দিয়েই চিকিৎসার খরচ মেটাচ্ছেন।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কক্ষে দুর্ঘটনায় হতাহত ৩৫ পরিবারগুলোর মধ্যে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। প্রত্যেক পরিবার পেয়েছে পাঁচ লাখ টাকা করে।

সর্বশেষ সংবাদ