ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবদান

মোঃ হায়দার আলীঃ পৃথিবীর বুকে বিধাতার আর্শীবাদে দু’একজন মহাপুরুষের আর্বিভাব ঘটে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের কাছে বিধাতার সেই আর্শীবাদ। ব্যক্তিত্ব, চেতনা, ধর্মসাধনা, সর্বোপরি জ্ঞান তপস্যায় তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
শিক্ষাবিদ, গবেষক, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, অভিধান প্রণেতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই চব্বিশ পরগনার বারাসতের নিকটবর্তী পিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্সী মফীজউদ্দীন মাতা হুরুন্নেসা। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ছিলেন।
১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক দর্শনতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) ডিগ্রি অর্জন। এছাড়াও, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরবন বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস থেকে পি.এইচডি ডিগ্রি (১৯২৫) লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন; তারপর সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বেদ পঠনের অনুমতি দেননি পন্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। স্যার আশুতোষের চেষ্টায় ও কলিকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি বেদপাঠের সুযোগ পান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সালে পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে পি.এইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ – ১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
বিভিন্ন ভাষায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র দখল ছিল অসাধারণ ও অসামান্য। উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১ – ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়। শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাঁকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স পদক’ ও মরণোত্তর হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাঁকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মরণোত্তর ‘ডি লিট’ উপাধি দেয়।
১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তাঁর নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকারী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎ কুমারী লাহিড়ী গবেষণা সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। অবসর গ্রহণের পরপরই বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের ফারসি ভাষার খন্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষপদের দায়িত্ব পান। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তৎকালীন “পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান” প্রকল্পের সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে বাংলা একাডেমিতে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমী কর্তৃক গঠিত বাংলা পঞ্জিকার তারিখ নির্ণয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ওই কমিটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক ও যুক্তি যুক্ত ব্যবহারিক বাংলা পঞ্জিকা প্রস্তুত করে যা বর্তমানেও অনুসৃত হয়ে থাকে। চর্যাপদের পদ কর্তাদের কাল ও ভাষার বৈশিষ্ট্য নির্ণয় বিদ্যাপতির কবিতার পাঠ্যোদ্ধার, চন্ডীদাস সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে মতামত প্রদান করেছেন বলা যায় তা সর্বজন স্বীকৃত।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সারাজীবনের সাধনায় বেশ কয়েকটি ভাষাআয়ত্ত করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত¡ পড়তে এবং সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী করতে গিয়ে তিনি হিন্দি, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, সিংহলি, বৈদিক, প্রাকৃত, তিব্বতি প্রভৃতি ভারতীয় ভাষা আয়ত্ত করেন। তাঁর এরূপ ভাষা জ্ঞান ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত¡ চর্চা, ভাষার ইতিহাস রচনা, অনুবাদ কর্ম, ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির কেবল চর্চা করেই দায়িত্ব শেষ করেননি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষ্যে লেখনির মাধ্যমে ও সভা সমিতির বক্তৃতায় জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে-
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ, ইকবাল, আমাদের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যের কথা (প্রথম খন্ড), বাংলা সাহিত্যের কথা (২য় খন্ড), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত।
ধর্ম ও সংস্কৃত গ্রন্থঃ শেষ নবীর সন্ধানে, মহরম শরীফ, ইসলাম প্রসঙ্গ, কুরআন প্রসঙ্গ, হজ্জের ও রওযা পাকের জিয়ারতের দোয়া দরুদ, রোযাহ ঈদ ও ফিতরাহ।
অনুবাদগ্রন্থঃ দীওআন-ই-হাফিজ, শিকওয়াহ, ও জওয়াব-ই-শিকওআই, রুবাইয়াত-ই-উমর খইয়ম, মহানবী, বাইআত নামা, বিদ্যাপতি শতক, অমর কাব্য কুরআন শরীফ (অনুবাদ ও ভাষাসহ প্রকাশিত), বুখারী শরীফ, ঈদুল আযহা ও কুরবানীর আহকাম।
ছোটগল্পঃ রকমারী।
শিশু সাহিত্যঃ ছোটদের ইসলাম শিক্ষা, ছোটদের দিনিয়াত শিক্ষা, চরিত্র কথা, জ্ঞানের কথা, কথা মঞ্জুরী, নীতিকথা, সিন্দাবাদ সওদাগর, ছোটদের রাসুলুল্লাহ, সেকালের রূপকথা।
সম্পাদিত গ্রন্থঃ পদ্মাবতী, গল্প সঞ্চয়ন, পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ইসলামী বিশ্বকোষ, উর্দূ অভিধান।
সম্পাদিত পত্রিকাঃ আল ইসলাম (মাসিক), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (ত্রৈমাসিক), আঙ্গুর (শিশুদের মাসিক পত্রিকা), ঞযব চবধপব (গড়হঃযষু), বঙ্গভূমি (মাসিক), তক্বীর (পাক্ষিক)।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদ লাভ করেন। গবেষণা কর্মের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান “প্রাইড অব পরফরমেন্স” ফরাসী সরকার “নাইট অব দি ওর্ডার অব আটর্স এন্ড লেটার্স (১৯৬৭ খ্রি.)” পদকে ভূষিত করেন। এই মহান জ্ঞান তাপস দেড় বছর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হল চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ধর্মের প্রতি এত অটল বিশ্বাস থাকা সত্তে¡ও তাঁর মধ্যে কোন গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু ছাত্রের বিয়ে তাঁকে দাওয়াত করেছেন। ছেলের মতো স্নেহ করেন ছাত্রকে। তার মনে কষ্ট দিতে পারেন না। ব্রাহ্মন ছাত্রের বাড়িতে তাদের হাতের রান্না খেয়ে বরবধুকে সুখময় দাম্পত্য জীবনের আশীর্বাদ করে ফিরেছেন। ছাত্রের স্ত্রীকে বউমা বলে সম্বোধন করতেন।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী, সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা। সাধারণ সম্পাদক, গোদাগাড়ী প্রেস ক্লাব। প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় গোদাগাড়ী, রাজশাহী।

সর্বশেষ সংবাদ