অবশেষে জেলহাজতে সেই উপসচিব

অনেক নাটকীয়তার পর রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

শনিবার বিকাল ৫টায় শুনানি শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোহা. আবু কাহার উপসচিব নুরুজ্জামান ও তার সহযোগী লাজুককে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি পাজেরো গাড়িতে করে ৫টি বড় কোকের বোতলে ফেনসিডিল কিনে রাজশাহীতে ফেরার সময় শুক্রবার রাত ৯টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহানন্দা সেতুর টোলঘর এলাকায় একজন সঙ্গীসহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে আটক করা হয়।

ড্রাইভার না নিয়ে মোহাম্মদ নুরুজ্জামান নিজেই সরকারি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সম্প্রতি উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। খবর যুগান্তর অনলাইন

এদিকে অভিযানের সময় মোহাম্মদ নুরুজ্জামান নিজেকে উপসচিব পরিচয় দেন। খবর পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের অভিযানিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নুরুজ্জামানকে নিয়ে সার্কিট হাউসে তোলেন।

রাতে তাকে সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এনডিসি মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তাদের বিদায় করে দেন। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তাদের আর সার্কিট হাউসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তারা সারারাত সার্কিট হাউসের প্রধান ফটকে পাহারায় কাটান।

নুরুজ্জামানকে হস্তান্তর নিয়ে দিনভর প্রশাসনের সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তাদের দেন-দরবার ও টানাপোড়েন চলে।

এদিকে শনিবার দিনভর অপেক্ষার পর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউস থেকে বের করা হয়।

হেফাজতে পাওয়ার পর মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তারা উপসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ও তার সহযোগী ওয়াহিদুজ্জামান লাজুককে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক সাইফুর রহমান বাদী হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে উপসচিব নুরুজ্জামান ও তার সঙ্গীকে আসামি করে সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। অপর আসামি লাজুকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে।

শনিবার বিকাল ৫টায় সহযোগীসহ নুরুজ্জামানকে আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে নুরুজ্জামান ও লাজুককে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন।
রাজশাহী বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব) মোহা. জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, কোকের ৫টি বড় বোতলে ফেনসিডিল ভর্তি করে মোহাম্মদ নুরুজ্জামান চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে নিজের সরকারি গাড়িতে করে রাজশাহীর দিকে ফিরছিলেন। সেখানে আগে থেকেই মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছিলেন। কালো রঙের সরকারি পাজেরো জিপটি রাত ৯টার দিকে  মহানন্দা সেতুর টোলঘর এলাকায় এলে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তারা তল্লাশির জন্য গাড়িটির চালককে দাঁড়াতে বলেন।

ওই সময় চালকের আসনে বসা ব্যক্তি নিজেকে সরকারের একজন  উপসচিব পরিচয় দিয়ে গাড়ি তল্লাশিতে প্রবল আপত্তি করেন। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতিসাপেক্ষে গাড়িতে তল্লাশি করে কোকের ৫টি বড় বোতল পান। বোতলগুলো খুলে সেগুলোতে তরল ফেনসিডিলে ভর্তি বলে তারা শনাক্ত করেন। এসব তরল ফেনসিডিল ৬৫ বোতলের সমান ও পরিমাণে  ৬ দশমিক ৭ লিটার সমান বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে উপসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে তারা নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইলে খবর পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যান। গাড়িটি সার্কিট হাউসের ভেতরে রাখা হয়।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা নুরুজ্জামানকে সার্কিট হাউসের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তাদের সেখান থেকে বের করে দেন। এরপর শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তাদের আর সার্কিট হাউসের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। সাংবাদিকদেরও সার্কিট হাউসের প্রধান ফটকে আটকে দেয়া হয়। মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে হস্তান্তর নিয়ে প্রশাসনের গড়িমসি ও সিদ্ধান্তহীনতায় কাটে পুরো দিন।

উপসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কাছে হস্তান্তর না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শনিবার বিকাল সোয়া ৩টায় চাঁপাইনবাগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহা. মঞ্জুরুল হাফিজ যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রশাসন থেকে কোনো আপত্তি করিনি। বিষয়টি মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের নিজেদের সিদ্ধান্তের বিষয়। তারা কেন উপসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে সার্কিট হাউস থেকে বের করে নিয়ে যায়নি সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। কেউ অপরাধ করলে তার দায় প্রশাসনের বা সরকারের নয়। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। এখানে কারও বাধা দেয়ার কিছু নেই। আমরা শুধু মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের পরিচয় ও পদবির বিষয়ে নিশ্চিত হতে সার্কিট হাউসে এনে তুলেছিলাম।

অন্যদিকে জেলা পরিষদের গাড়ি নিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুজ্জামানের ফেনসিডিলসহ আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, মাত্র কিছুদিন আগে মোহাম্মদ নুরুজ্জামান রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে কোথায় ছিলেন তা আমার জানা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে ডেপুটেশনে রাজশাহী জেলা পরিষদে পদায়ন করেছেন। যদি কোনো অপরাধ কেউ করেন তার দায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার। তার দায় জেলা পরিষদের নয়।

খোঁজ নিয়ে উপসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত হন। মোহাম্মদ নুরুজ্জামান নিয়মিত নিষিদ্ধ মাদক সেবন করেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় পুঠিয়া থেকে ফেনসিডিল সেবনের জন্য তিনি প্রতিদিনই সীমান্তবর্তী চারঘাট ও বাঘার বিভিন্ন মাদক স্পটে সরকারি গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতেন; যাকে সামনে পেতেন তাকেই মারধর করতেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, মাদক সেবন করে প্রায়ই তিনি ভ্যানচালক রিকশাচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে লাঠিপেটা করাসহ মারামারিতে লিপ্ত হতেন। ওই সময় পুঠিয়া থেকে তাকে অপসারণ করতে এলাকাবাসী জেলা প্রশাসনসহ জনপ্রশাসন সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। তবে নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে পার্শ্ববর্তী জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বদলি করা হয়।

সেখানেও মোহাম্মদ নুরুজ্জামান নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকাণ্ড শুরু করেন। পুঠিয়ার মতো জোর-জবরদস্তি ও শৃঙ্খলাপরিপন্থী কর্মকাণ্ডের কারণে মান্দাতে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছিল। কিছুদিন নওগাঁ জেলা প্রশাসন অফিসে সংযুক্ত থেকে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে রাজশাহী জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা পদে পদায়ন হন। যোগদান করার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ফেনসিডিলসহ আটক হলেন।

 

সর্বশেষ সংবাদ