জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত  

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ-জিল হজ্জ্ব, আরবি বার মাসের শেষ মাস এবং মসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতের মাস। যে মাসে মুসলিম উম্মাহ পবিত্র হজ পালন করে থাকেন জিলহজ মাস মানে হজের মাস।হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ—এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে, আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, তোমরা আমাকে ভয় করো’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৭)।বছরের বারো মাসের চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি, যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)। এই চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহবিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, (যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এ-ই আল্লাহর নিকট তোমার কোরবানি’ (আবু দাউদ, নাসাই, ত্বহাবি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা: ৩০৫)।★জিলহজ মাসের ১ম ১০ দিনের বিশেষ আমলঃ-জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের ফজিলত জিহাদের চেয়েও মর্যাদাবান। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) আমলের তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোনো সময় উত্তম নয় । তারা বলল : জিহাদও না ? তিনি বললেন : জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি।’ (বুখারি)
* আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে কোনো দিনই প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ দশ দিনের তুলনায়। সুতরাং তোমরা তাতে (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ কর।’ (তাবারানি)কুরআন ও হাদিসের আলোকে ওলামায়েকেরামও জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদতে একনিষ্ঠভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতেন। যার প্রমাণ দিয়ে গেছেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়েকেরাম।
*  হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহিমাতুল্লাহি আলাইহি জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ইবাদতে নিজেকে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত রাখতেন। যেভাবে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিলহজ মাসে ইবাদত-বন্দেগি করতেন।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন জিলহজ মাসের ১০ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।’ (দারেমি)
* হজরত ইবনে হাজার আসকালানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘জিলহজ মাসের ১০ দিনের ফজিলতের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট তা হচ্ছে- এখানে মূল ইবাদাতগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ নামাজ, রোজা, সাদকা ও হজ। যা অন্যান্য সময় যথাযথভাবে আদায় করা হয় না।’ (ফতহুল বারি)
পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ রাত যেমন মর্যাদার ঠিক মুমিন মুসলমানের জন্য জিলহজের প্রথম ১০ দিন ও রাতের ইবাদত-বন্দেগিও অনেক মর্যাদা ও সম্মানের।মুসলিম উম্মাহর উচিত, জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালনের মাধ্যমে অধিক সাওয়াব ও ফজিলত লাভের করা। বিগত জবিনের গোনাহ থেকে নিজেদের মুক্ত করা। আল্লাহর নৈকট্য ও ভয় অর্জন করা।
উল্লেখ্য যে, ১১ জুলাই  সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা সাপেক্ষে শুরু হতে পারে জিলহজ মাস। যদি ১২ জুলাই  সন্ধায় চাঁদ উঠে  তবে ১৩ জুলাই থেকে নিশ্চিত শুরু হবে জিলহজ মাস। আর সেদিন থেকে কুরবানির আগ পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগি ও রোজা পালনই হবে মুমিন মুসলমানের জন্য সর্বোত্তম কাজ।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজের মাস জিলহজের প্রথম ১০ দিন রোজা পালন এবং রাত জেগে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
★জিল হজ মাসের মুস্তাহাবি আমলঃ-চুল, নখ ইত্যাদি পশম কাটাছাটা
জিলহজ মাসের আরেকটি মুস্তাহাবি আমল হল, চাঁদ উঠার আগে নখ, চুল আর পশমাদি কাটাছাটার প্রয়োজন হলে কেটেছেটে ফেলা এবং কুরবানির দিন পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগ পর্যন্ত এসবে হাত না দেয়া।এতে করে উক্ত আমলকারী কুরবানি করার ছুয়াব পায়। সুতরাং যারা কুরবানি করলনা তারা কুরবানি করার নেকি পাইল আর যারা কুরবানি করল, তারা কুরবানির দ্বিগুণ নেকি পাইল। তবে সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি কুরবানি না করে ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে।
সতর্কতা: বগল আর নাভির নিচের কেশ যদি কাটতে ছাটতে ৪০ দিনের বেশি দেরি হলে বা আপনি ভুলে গেলেন কাটতে, আবার এদিকে কুরবানির চাঁদ উদয় হয়ে গেছে। এমন যদি হয় তাহলে চাঁদ উদয় হলেও আপনি যা কাটার তা কাটতে ছাটতে পারবেন।নারী পুরুষের অভিন্ন হুকুম। কারণ ৪০ দিনের বেশি হয়ে গেলে নামায ইত্যাদি মাকরূহে তাহরিমী হয়। যা পূর্বেকার মুস্তাহাবি আমলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।★তাকবিরে তাশরিকঃ-তাকবিরে তাশরিক হল, যে তাকবির জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত পড়া হয়। যে কারণে এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরিক বা তাশরিকের দিন বলা হয়। দিন হিসেবে পাঁচদিন হয়।পুরুষদের পড়তে হয় বড় আওয়াজে আর মহিলাদের পড়তে হয় ছোট আওয়াজে। তাকবীর যদিও ওয়াজিব কিন্তু, মহিলাদের আওয়াজ ছতর হিসেবে ছোট আওয়াজে পড়াই বাঞ্ছনীয়।এই তাসবীহ কেবল একবার পড়া ওয়াজিব, তিনবার পড়া ওয়াজিব নয়।এ মর্মে হযর‍ত আলী ও আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, আরফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আছর পর্যন্ত। (অর্থাৎ কুরবানিত ৩য় দিন আছর পর্যন্ত।)
* তাকবিরে তাশরিক নিচে দেয়া হল।হযরত ওমর ও আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তাকবিরে তাশরিক এই,আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওলিল্লাহিল হামদ।মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে জিলহজ মাসের বরকত থেকে কল্যাণ মণ্ডিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ সংবাদ