নিরবে নিভৃতে নিজ বাড়িতেই ঘুমিয়ে আছেন সাহিত্য বিশারদ ফজলল করিম

শাফায়াত সজল, লালমনিরহাট থেকে ফিরেঃ বাঙালি মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্যের লেখনীর মধ্য দিয়ে যে কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে শেখ ফজলল করিম হলেন অন্যতম। ‘‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।’’ কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কাব্য রত্নাকার, নীতিবাদী সাহিত্যিকের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হতে চলেছে।
কবি শেখ ফজলল করিম লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮৩ সালের ১লা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নাম আমীর উল্লাহ সরদার ও মাতার নাম কোকিলা বিবি। তিনি শৈশবে কাকিনা স্কুল থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রংপুর জেলা স্কুল থেকে তিনি মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন। ছাত্র অবস্থায় কাকিনা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিনবিনিয়া গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরগণ নেসা খাতুনের সাথে। কবিপত্নী ১৯৬২ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন ।
দাম্পত্য জীবনে দুই পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন কবি। তার প্রথম পুত্র মাত্র ৩ দিন জীবিত ছিল। দ্বিতীয় পুত্রের নাম মতিয়ার রহমান। কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমডি.কোম্পানিতে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানির মন যুগিয়ে কাজ করতে না পারায় স্বীয় চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সি মেহেরউল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭ খ্রি:) অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়ে ছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান শেখ ফজলুল করিম কাকিনায় নিজ বাড়িতে তার পীর সাহেব হযরত মওলানা মহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দীনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস’। তিনি শেষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লেখার জগত নিয়েই তার বর্নাঢ্য জীবন অতিবাহিত করেন।
তার সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ ছোট বেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি “সরল পদ বিকাশ” কবিতা গুচ্ছ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি আজীবন সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তার সাহিত্যকর্মে ধর্ম ও নীতি শাস্ত্র বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে তিনি প্রভুত সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়, ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আহমেদিয়া লাইব্রেরী’ নামক একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের বাধা ধরা নিয়ম কানুন তার কখনোই ভালো লাগেনি। তবে বাইরের প্রচুর বই অধ্যয়নে তার অনীহা ছিল না। বিশেষ করে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রচুর জ্ঞান পিপাসা ও অনুশীলন তার লেখার জগতকে সমৃদ্ধি করেছে। শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টি ভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদ গুণে তার সৃষ্টি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে।
শেখ ফজলল করিমের পরিচিতি মূলতঃ একজন কবি হিসেবে আমরা দেখি কিন্তু তিনি কবিতা ও কাব্য ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গবেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠন মূলক তত্ত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতি কথা, চরিত্র গ্রন্থ এবং নানাবিধ সমালোচনা মূলক রচনা, সাহিত্যের সকল শাখায় ছিল তার প্রবল পদচারণা। ইসলাম প্রচারক, নবনূর, কোহিনুর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারতবর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শিশুসাথী, কল্পতরু, মোসলেম ভারত, সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী, আলহক, বসুমতি ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় ফজলল করিমের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, কাব্য, জীবনী ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সমকালীন মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রিঃ) নেতৃত্বে যে নবতর সাহিত্য প্রচেষ্টার উন্মেষ এই দেশে ঘটেছিল তার সার্থক ধারক ও বাহক ছিলেন শেখ ফজলল করিম।
জীবিত কালেই তিনি পেয়েছেন তার সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি। “পথ ও পাথেয়” গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্য পদক পান। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে ‘‘সাহিত্য বিশারদ’’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ‘’চিন্তার চাষ’’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন “নীতি ভূষণ” উপাধি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে খিদিরপুর মাইকেল লাইব্রেরি থেকে মধুস্মৃতি কবিতার জন্য তিনি রৌপ্য পদক পান। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকারের রৌপ্য পদক তিনি পেয়েছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকা কালে। এছাড়াও তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে দিয়েছিল কাব্যভূষণ, সাহিত্যরত্ন, বিদ্যাবিনোদন, কাব্যরত্নাকর উপাধি সহ বিভিন্ন সম্মাননা । শেখ ফজলল করিম কাকিনা থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে। ‘বাসনা’ পত্রিকাটি দু’বছর চালু ছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান মিলন সম্ভব এটি ছিল তার অভিমত। এই পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুর-এর প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট) এবং আরো অনেক স্বনাম খ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো। ঐ সময় ‘বাসনা’ পত্রিকাটি ছিল পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা।
বিভিন্ন সূত্র থেকে ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আনুমানিক মোট ৫৮টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থগুলি হলোঃ- সরল পদ্য বিকাশ (বাল্যকালের রচনা), তৃষ্ণা (কাব্য), মানসিংহ, পরিত্রাণ, (কাব্য), ভগ্নবীনা বা ইসলাম চিত্র, লায়লী মজনু আফগান স্থানের ইতিহাস, ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি, গাঁথা, হারুন-অর-রশীদের গল্প, বিবি রহিমা, পথ ও পাথেয়, রাজর্ষি এবরাহিম, চিন্তার চাষ, বিবি খাদিজা, বিবি ফাতেমা, মোহাম্মদ চরিত, বিবি আয়েশা, ছামিতত্ত্ব বা ধর্মসঙ্গীত ইত্যাদি। তিনি ওমর খৈয়ামেরও বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। শেখ ফজলল করিমের গদ্য রচনা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ভাষা নির্মাণে তার অসাধারণ দক্ষতা। তার সাহিত্য সৃষ্টিতে ছিল একটা নিজস্ব সুর, নিজস্ব ভাষা। আবেগ উপলব্ধি ও অনুভূতি প্রকাশের সে ভাষাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেছেন। স্বাচ্ছন্দ গতিময়তা তার লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কবির স্বর্গ ও নরক নামক কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ ও কবি ‘মালঞ্চ’ নামক দুটি পাঠ্য পুস্তকে গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তার কবিতা পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘’কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক’’ বিখ্যাত কবিতার কবি হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে তিনি আজও সুপরিচিত। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সুস্থ মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে কবি বা গদ্য লেখক হিসেবে তিনি তার সাহিত্যের মাধ্যমে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এটা তার অসীম কৃতিত্বের পরিচয়। বরেণ্য এই কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাকিনাস্থা তার নিজ বাসভবন “কবিবাড়ি”র পারিবারিক কবরস্থানে তিনি চিরশায়িত আছেন। ভাল থাকুক কবি, শিক্ষার্থীরা তার কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠুক মানবিকগুণ সম্পন্ন বিবেকবান মানুষ এই প্রত্যাশ্যায় করি।
তথ্যসুত্রঃ কবি নাতি, স্থানীয় এলাকাবাসি, ইউকিপিডিয়া, জাতীয় ২টি দৈনিক পত্রিকা।

সর্বশেষ সংবাদ