বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী —–মোহাম্মদ নজাবত আলী

ইতিহাসের একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, যারা নির্যাতিত নিপীড়িত গণমানুষের স্বার্থক প্রতিনিধি হিসাবে স্বাধীন জাতি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতির জনকের অভিধায় অভিসিক্ত হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশের জীবনে নেমে এসেছে অনাকাংখিত ঘটনা, ঘোর অমানিশা। ভারতের গান্ধী থেকে বঙ্গবন্ধু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ থেকে আমেরিকার আর্বাহাম লিংকন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির প্রতীক মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ।
আগস্ট মাস শোকের মাস। আজ ১৫আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদত বার্ষিকী। কতগুলো বিপথগামী সামরিক অফিসার তাঁর ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহা কলঙ্ক। যিদি আঁধারে দিয়েছেন আলো তাঁকেই হত্যা করে ঘাতকরা। অমানিশার অন্ধকারে ঠেলে দিলো গোটা দেশ।

তাঁর অপমৃত্যু জাতির করুন ট্রাজেডি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩বছরে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির অত্যাচার, নির্যাতন ও অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে নিয়ে রুখে দাঁড়ান। বাঙালি হাজার বছর পরাধিন ছিল। বাঙালির হাজার বছরের দুঃখ বেদনা অত্যাচার, নির্যাতন, আশা আকাংখা ও আবহমান বাঙলার সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বঙ্গবন্ধু নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন।

তাঁর কণ্ঠে বাঙালি জাতির সবচাইতে বড় আকাংখা স্বাধীনতার ধ্ববি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, শান্তিকামী মানুষের সার্থক প্রতিনিধি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রবক্তা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। বঙ্গবন্ধুর বড় কৃতিত্ব একটি ভাষা ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আজ সারা বিশ্বে তাঁর সবচাইতে বড় পরিচয় জাতির পিতা হিসাবে।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন ছিল শাসন শোষনের অবসান ঘটিয়ে বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। তাঁর হাত ধরে তিনি রাজনীতিতে এসে বাঙালি জাতির জন্য একটি ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তিনি বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

সে ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন বাঙালির মধ্যমনি। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক অনেক রাজনীতিবিদ ছিলেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাদুকর। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। স্বাধীনতার বাঁশি বাজিয়েছেন আর সমগ্র জনগোষ্ঠি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাঁকে অনুসরণ করেছে। রক্ত দিয়েছে, তাঁর কথায় উঠেছে, বসেছে, হেঁসেছে, কেঁদেছে। তাঁকে বাদ দিয়ে বিগত ২৩বছরে পাকিস্তানের শাসন, শোষনের ইতিহাস ও বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারেনা। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেন একই সূত্রে গাঁথা। তাঁর প্রচন্ড সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই তিনি শুধু একজন মানুষ হিসেবেই নয় রাজনৈতিক দর্শনের প্রশ্নেও গোটা জাতিকে এমনভাবে এককাতারে নিয়ে এসেছেন যা ইতিহাসে খুবই বিরল ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সাময়িকভাবে বিক্ষিপ্ত হলেও সে দর্শন, আদর্শ আজও অধিকাংশ বাঙালিকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।
মুজিবের আপোষহীন নেতৃত্ব রাজনৈদিক দূরদর্শিতা, আদর্শ ও মহিমা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অভিসিক্ত হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির অভিধায়।

একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ ও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ দেশকে তিনি পূর্নগঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম ও দেশের প্রতি অকৃতিম ভালোবাসার কারণে। তবে একথা ঠিক যে, অনেকে বলে থাকেন মুজিব সরকার ছিল ভারতের আর্শিবাদপুষ্ট। এ কথা কোন ক্রমেই ঠিক নয়। ৭২সালের ১০জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরিয়ে এসেই প্রথমে বললেন কবে ভারতের সেনা দেশ থেকে ফিরে যাবে। তিনি কখনো চাননি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিদেশী সেনাদের উপস্থিতি নিয়ে কোনো কথা বিতর্ক রাজনীতি হোক। তিনি অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইদ্রাগান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান এবং ্ইদ্রাগান্ধী সে অনুরোধ রক্ষা করে স্বপ্ল সময়ের মধ্যেই তাঁর সৈন্য বাহিনীকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনেন। একটি সুশৃঙ্খল ও বিজয়ী বাহিনীকে নিজ দেশে প্রতাবর্তন করা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বের কারণে।
সাফল্য ব্যর্থতা নিয়েই মানব জীবন। শেখ মুজিব তাঁর উর্দ্ধে নন। তাঁর জীবনে সাফল্যের যেমন সুউচ্চ পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি ব্যর্থতার পরিমানও নগন্য নয়। তবে সবচাইতে বড় কথা তিনি একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন এবং শিখিয়েছিলেন অধিকার আদায়ের ভাষা। তাঁর দৃঢ় রাজনৈতিক ভূমিকা দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ সোপানটিতে পৌঁছে দেয়। তাই একথা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, কিছু ব্যর্থতা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদানের কাছে ম্লান। এমন মহান ব্যক্তি যুগবতার অনেক জাতির ভাগ্যে জোটেনি।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সংবিধান প্রনয়ন, মানচিত্র, ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার, দেশ পূর্নগঠনের সফলতার ইতিহাসে তিনি চির স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সাহসী দেশ প্রেম, আপোষহীন নেতৃত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। একটি সাধারণ পরিবার থেকে বেগে উঠা আপোষহীন চরিত্র কিভাবে জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ চরিত্রে পরিনত হয় তা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরনীয় ও বিষ্ময়করও বটে। তাঁর মতো একজন সংগ্রামী নেতাকে আমরা পেয়েছিলাম বলেই স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ আওয়ামীলীগ নেতারা যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে তাদের নিজস্ব বলয়ে রাখতে চান তা মোটেও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখা উচিত মুজিব কোনো দলের নেতা বা সম্পদ নয়। তিনি জাতীয় নেতা, জাতীয় সম্পদ। তাই সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের উচিত হবে এ মাপকাঠিতে তাঁকে মূল্যায়ন করা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর সোনার বাংলা। এলক্ষ্যে তিনি এগিয়েছিলেন কিন্তু ঘাতকরা তাঁকে আর এগোতে দেয়নি।

তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন ও তাঁর প্রতি যথার্থ ভালোবাসাই সোনার বাংলায় পরিনত হবে এ দেশ। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে অনেক নেতা, উপনেতা, পাতি নেতা বিভিন্ন পোস্টারে নিজের ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপিয়ে প্রচার, প্রচারনা চালায় যা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়। তাই দলীয় বলয় থেকে তাঁকে মুক্ত করতে না পারলে জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাঙালি বলে আমাদের কোনো পরিচয় ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি সারা বিশ্বে আমরা যে বাঙালি তার পরিচয় তুলে ধরে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসার টান, ভাষাআন্দোলনে কারাবরণ, অনশন, দেশপ্রেমী উজ্জিবিত হয়ে তিনি বলেছিলেন ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মৃত্যু (১৯২০-১৯৭৫) হিসেব করলে মাত্র ৫৫বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘকাল ধরে শোষিত বাঙলাকে সোনার বাঙলায় পরিনত করা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি পতাকা, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, মানচিত্র, সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমরা সে রাষ্ট্রের গর্বিত সন্তান। এসবের জন্য বাঙালি জাতি তাঁর কাছে ঋণী। এ ঋণ কোনদিন বাঙালি পরিশোধ করতে পারবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ভালোবাসা ঠিকই শোধ করে গেছেন বুকের রক্ত দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃর্তিমান পুরুষ। যুগে যুগে মহা পুরুষদের কৃর্তি মূছে ফেলা যায় না। আপন মহিমায় চিরভাঙ্কর। যুক্তরাষ্ট্রের জজ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মাগান্ধী, কিউবার ফিদেল ক্যাস্টো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ তেমনি বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান যশখ্যাতি, কৃর্তি বাঙালির মণ থেকে কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না। বিরোধী মহল এসব নিয়ে সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও সফল হবে না।
আজ ১৫আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদত বার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর মহান জাতীয়তাবাদী নেতাদের একজন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি মনিরুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ একটি মহাকাব্য। আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধু সে মহাকাব্যের প্রধানতম ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু মূলত এক ট্রাজিক মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধুর ৪০তম মৃত্যু দিবসে তাঁর সুমহান আদর্শ ও মহিমান্বিত স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

সর্বশেষ সংবাদ