গ্রাম আদালতের বিচার পেয়ে খুশী রেনু মিয়া

বিশেষ প্রতিনিধি: চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত কচুয়া উপজেলার সাচার ইউনিয়নের বাসিন্দা রেনু মিয়া (৬০)। স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে তার সংসার ভালই চলছিল। পেশায় কৃষক। নিজের কিছু জমি থাকলেও প্রতিবেশীদের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন এবং যা পান তাতে তার সারা বছর চলে যায়। এতে তার বড় কোন সমস্যা হয় না।

 রেনু মিয়ার প্রতিবেশী আলী আজগর। আজগরের স্ত্রীর বড় ভাই (সমন্ধি) সৌদি প্রবাসী। একদিন রেনু মিয়া জানতে পারেন যে, আজগরের সমন্ধি কেয়ারটেকার ভিশায় কিছু লোক নিবে। তাই তিনি আজগরকে রাজি করিয়ে প্রায় ৩৮০,০০০ (তিন লক্ষ আশি হাজার) টাকা খরচ করে ছেলেকে সৌদি পাঠান। কিন্তু কথা মোতাবেক সৌদিতে ছেলের চাকরী হয় না। এমতাবস্থায়, রেনু মিয়ার ছেলে সৌদির মরুভূমিতে কোনমতে একটি কাজ জোগাড় করে নেয়। এভাবে কষ্টের মধ্যে ছেলের জীবন কাটতে থাকে। কথা অনুযায়ী সৌদিতে কাজ না দেওয়ায় রেনু মিয়া আলী আজগরের সমন্ধির সাথে ফোনে সরাসরি কথা বলেন। এতে আজগরের সমন্ধি খুব দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষতিপূরণবাবদ ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) টাকা সৌদি থেকে আজগরের মারফতে রেনু মিয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আলী আজগর টাকাগুলো হাতে পাওয়ার পর রেনু মিয়াকে দিতে টাল-বাহানা শুরু করেন। টাকাগুলোর জন্য রেনু মিয়া বার বার আলী আজগরের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন এবং এলাকায় বহু সালিশ-দরবার করেছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

এভাবে একদিন রেনু মিয়া তার পাড়ায় প্রকল্পের অনুষ্ঠিত গ্রাম আদালত বিষয়ক এক উঠান-সভার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তার নিজ ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং এলাকার ছোট-খাট বিরোধ স্বল্প সময়ে সহজেই নিস্পত্তি করে দিচ্ছে। তিনি কালক্ষেপন না করে পরিষদে চলে আসেন এবং সেখানকার গ্রাম আদালত সহকারী মিঠুন চন্দ্র পোদ্দারের সাথে কথা বলেন। গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও বিচার প্রক্রিয়ার নানা বিষয়ে তিনি আরো ধারণা লাভ করেন। এভাবে সব কিছু জানার পর রেনু মিয়া আর দেরী করলেন না। ঐদিনই অর্থ্যাৎ ২৯/১১/২০১৮ তারিখে মাত্র ২০ টাকা ফি প্রদান সাপেক্ষে তার পাওনা মোট ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) টাকা ফেরত পাওয়ার জন্যে প্রতিবেশী আলী আজগরের বিরুদ্ধে গ্রাম আদালতে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন যার মামলা নম্বর হল ২৫/২০১৮।

গ্রাম আদালতের আইন অনুযায়ী সাচার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ ওসমান গণি মোল্লা ৫/১২/২০১৮ তারিখে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য মামলার প্রতিবাদী আলী আজগরের প্রতি সমন জারী করেন এবং একইভাবে হাজির হওয়ার জন্য আবেদনকারী রেনু মিয়াকে মামলার স্লীপ পাঠান। মামলার আবেদনকারী ও প্রতিবাদী উভয় যথাসময়ে আদালতে হাজির হন। এরপর উভয়পক্ষের মনোনীত দু‘জন দু‘জন করে মোট চার জন বিচারিক প্যানেল সদস্যদের নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান তার নিজের সভাপতিত্বে উক্ত মামলার জন্য আদালত গঠন করেন এবং শুনানীর জন্য ১৯/১২/২০১৮ তারিখ নির্ধারণের আদেশ দেন।

আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে আদালত বসে এবং শুনানী শুরু হয়। বিচারিক প্যানেল সদস্যগণ মামলার আবেদনকারী রেনু মিয়া ও প্রতিবাদী আলী আজগরের কাছ থেকে মামলার বিরোধীয় বিষয় বিস্তারিতভাবে শোনেন। মামলার বিষয়টি কিছুটা জটিল হওয়ায় ঐদিন বিরোধটি নিস্পত্তি করা সম্ভব হয়নি বিধায় শুনানীর জন্য পরবর্তীতে আরো কয়েকটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এভাবে কয়েকটি শুনানীর পর মামলার প্রতিবাদী দোষী সাব্যস্থঃ হন এবং এক পর্যায়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। এভাবে এক পর্যায়ে আদালতের বিচারিক প্যানেল সর্বসম্মতিতে রায় ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে মামলার আবেদনকারী রেনু মিয়াকে তার প্রাপ্য মোট ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) টাকা সসম্মানে ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন।

ঐদিনই মামলার প্রতিবাদী আলী আজগর ৫০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা আদালতের মাধ্যমে আবেদনকারীকে পরিশোধ করেন। বাকী ৬৫,০০০ (পয়ষট্টি হাজার) টাকা আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে দেন। এভাবে রেনু মিয়া তার দীর্ঘ দিনের পাওনা টাকা ফিরে পান।

সম্প্রতি রেনু মিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রতিবেদক যখন তার বাড়িতে যান তখন তিনি তার ক্ষেতে কাজ করছিলেন। তাই প্রতিবেদক সরাসরি তার ক্ষেতে যান এবং তার সঙ্গে কথা বলেন। গ্রাম আদালতে তার দায়ের করা মামলার বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই এক গাল হাসি হেসে তিনি বলেন, গ্রাম আদালত আমার হারিয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধার করে দিয়েছে। গ্রাম আদালত ছিল বলেই আমি আমার টাকা ফেরত পেয়েছি। আমার মত এলাকার অনেকে এই আদালতের মাধ্যমে উপকার পেয়েছে। ধন্যবাদ গ্রাম আদালত।

সর্বশেষ সংবাদ