মাদকের ভয়াল গ্রাসে রাজশাহীতে বাড়ছে হত্যাকান্ড

আহসান হাবিব রাজশাহী থেকে: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে সোমবার সকালে কান্না করছিলেন নিহত রাখির মা লিলা বেগম। এক সময় কান্না থামিয়ে বললেন, জামাই সোহেল প্রায় নেশা করে এসে রাখিকে (২৯) মারধর করতো। মারতে মারতে অসুস্থ করে দিতো। আমার মেয়েকে খুব অত্যাচার করেছে। রাখিকে অনেক বলেছি সোহেলকে ছেড়ে চলে আয়। সে আসেনি। আমার কথা শুনলে মেয়েটা মরতো না।

রাখি মারা যাওয়ার ঘটনা রোববার রাতের। নগরীর ডিঙ্গাডোবা এলাকার স্বামী সোহেল এর বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাখিকে। পরে এলাকাবাসি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় মৃত্যু হয় রাখির। রাখির মা লিলা বেগম ও আশেপাশের লোকজন জানান, রাখির স্বামী সোহেল মাদকাসক্ত। সামান্য কারণেই রাখির উপরে সে নির্যাতন করতো।

একই রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার আরিজপুর গ্রামে আরো একটি লোমহর্ষকর ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শাহাবুদ্দীনের মাদকাসক্ত ছেলে সালেক আহমেদ হাতুড়ী দিয়ে পিটিয়ে তার মা সেলিনা বেগমকে (৫০) হত্যা করে। সোমবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে মাদকাসক্ত স্বামী তার স্ত্রীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে।

অনেক আগে থেকেই শহর, গ্রাম সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। এখন মাদকের ভয়াল বিষে জর্জরিত হচ্ছে সমাজ। শহর অথবা গ্রাম সব জায়গায় প্রতিনিয়ত ঘটছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চুরির ঘটনা। এমন সমস্যা দিনে দিনে মানুষের কাছে প্রধান চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজশাহী ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে প্রায় দিনই ঘটছে খুন, আত্মহত্যা, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।

২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এ সংখ্যা এখন অতিত হয়ে আরো বেড়েছে।

সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ি, বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে। মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেন্সিডিলে আসক্ত ছিল, তাদের বেশির ভাগই এখন ইয়াবা আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণসমাজকে গ্রাস করেছে। প্রতিদিন যেমন ইয়াবা ধরা হচ্ছে, তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে।

মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকে; হিসাব অনুযায়ী মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক কারবারি প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতিবছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

সীমান্ত এলাকা হওয়ার কারণে দেশের এ চিত্রের থেকেও রাজশাহী ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। সীমান্তে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ইয়াবা, ফেন্সিডিল।

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (ভো.) বিদ্যালয়ের সুপারিনটেনডেন্ট আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, আমাদের সমাজের জন্য মাদক এখন সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রতিটি পরিবারকে আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে। কোনভাবেই যাতে একটি সন্তানও মাদকের ভয়াল থাবার শিকার না হয়।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের আরো বেশি স্বোচ্চার হতে হবে। মাদকের কারণে বহু পরিবার নি:স্ব হচ্ছে। সমাজে খুন থেকে শুরু করে নানান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বেড়েছে মাদকের কারণে। যে কোন মূল্যে আমাদের নতুন প্রজন্মকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সেটা না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

সর্বশেষ সংবাদ