রাণীনগরে ৪ দিন ধরে দুই পরিবারকে এক ঘরে মানবেতর জীবন-যাপন

রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁর রাণীনগরে পর-পুরুষের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলার জ্বের ধরে গ্রামের কতিপয় মোড়ল গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে ছেলেকে ৬ হাজার টাকা জরিমানা ও মেয়ে পক্ষের দুই পরিবারকে ৪ দিন ধরে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। সেই সাথে কাজ-কাম, চলাফেরা, দোকান থেকে কেনা-কাটা, পাড়ার কোন ধরনের যানবাহনে চড়া বন্ধসহ গ্রামের কোন লোকজন তাদের সাথে কথা বললে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এমন অলিখিত আদেশ জারি করা হয়েছে। সাথে সাথে গ্রামের যে সমস্ত খেটে খাওয়া নারী শ্রমিক আছে, তাদেরকেও স্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করতে বাহিরে না যাওয়ার নিষেধাক্কা জারি করা হয়।
অসহায় হতদ্ররিদ নারী শ্রমিকরা বলছেন, দু-মোঠো ভাত জোগার করার জন্য কোন জায়গায় কাজ করবো এধরণের সুযোগটুকুও গ্রামের কতিপয় মাতব্বরা বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতভাগা নারী শ্রমিকরা এখন নানান অভাব-অনাটনের মধ্য দিয়ে আতংকিত জীবন-যাপন করছে। কথিত মোড়ল গুলো রাত-দিন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধামকির কারণে খেয়ে না খেয়ে অনিশ্চত দিন কাটাচ্ছে নারী শ্রমিকদের। প্রতিবাদ করতে গেলেই নেমে আসছে প্রভাবশালী মোড়লদের অত্যাচারের খড়গ। বিধাব নারীরা বাজার-সদা করা তো দূরের কথা ঔষুধপত্র কিনতেও দিচ্ছে না তারা। আক্ষেপ করে সরকারী কর্মসৃজন প্রকল্পের এক নারী শ্রমিক বলেন, নিজ ঘরেই, নিজ গ্রামেই পরো বাস! এ যেন মগের মল্লুক!
জানা গেছে, উপজেলার কালীগ্রাম ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের মানিক প্রামানিকের ছেলে রাজমিস্ত্রি অনন্ত চন্দ্র প্রামামিক এর স্ত্রীর সাথে একই গ্রামের বিনত চন্দ্র এর ছেলে নেপেন চন্দ্র মোবাইল ফোনে অনৈতিক কথা-বার্তা বলে এমন অপবাদ দিয়ে ওই গ্রামের কতিপয় মাতব্বর খোকন, সুশীল, গৌরাঙ্গ, গঙ্গা, গোপিনাথ সহ ৮/৯ জন মিলে গত এক মাসে গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে নেপেন চন্দ্র’র ৬ হাজার টাকা জরিমানা করে। এরপর থেকে রাজমিস্ত্রি অনন্ত চন্দ্র, তার স্ত্রী ও শ্বশুর কালীপদ মহন্ত’র (একই গ্রাম) পরিবারকে একই কায়দায় গ্রাম্য শালিসের মুখো-মুখি করতে জোর তৎপরতা চালায়। কিন্তু অনন্তর শ্বশুর কালীপদ ওই গ্রামের একজন মাতব্বর হওয়ার কারণে তারা পাত্তা না পেয়ে গত মঙ্গলবার রাত অনুমান ১২ টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক গ্রাম প্রধান খোকনের নেতৃত্বে ৭/৮ জন মিলে অনন্ত ও তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ডাকা-ডাকা শুরু করে। বাড়ির ভিতর থেকে সারা দিলে মাতব্বর খোকন, সুশীল বলে চাচা তোমার মেয়ে-জামাই এর সমস্যা আছে। এবিষয়ের সমাধানের লক্ষ্যে এখনি গ্রাম্য শালিস বসাবো, তোমাদের যেতে হবে। জামাই-শ্বশুর একযোগে না বললে মাতব্বরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাণনাশের হুমকি-ধামকি সহ নানান ভয়ভীতি দেখায় এক পর্যায়ে ওই রাতেই খোকনের নের্তৃত্বে একঘেয়ামি গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে শ্বশুর-জামাই দুই পরিবারকে সমাজচুত্যের মাধ্যমে একঘরে করে রাখার ঘোষনা দেয়া হয়। সাথে সাথে এই গ্রামের কেউ ওই দুই পরিবার এর সাথে লেনদেন, চলাফেরা, কাজকর্ম, কথা-বার্তা বললে তার ৫ হাজার টাকা জরিমানা করার অলিখিত আদেশ জারি করা হয় বলে একঘরে হওয়া কালীপদ মহন্ত জানান। এমনকি হরিপুর গ্রামের শ্রমজীবি কোন মহিলা গ্রামের বাহিরে কাজকর্ম সহ কোন ধরণের চলাফেরা করতে পারবে না। এমনিতেই ওই গ্রামে শ্রমজীবি মানুষের সংখ্যা বেশি। সব মিলে মাতব্বরদের দাপটে প্রায় ২ শ’ জন শ্রমজীবি মহিলা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অসহায় হয়ে পড়েছে। আক্ষেপ করে সরকারী কর্মসৃজন প্রকল্পের এক নারী শ্রমিক বলেন, নিজ ঘরেই, নিজ গ্রামেই পরো বাস! এ যেন মগের মল্লুক!
হরিপুর গ্রামের গোবিন্দ চন্দ্র মহন্তর ছেলে গ্রাম প্রধান খোকন চন্দ্র মহন্ত জানান, অনন্ত’র স্ত্রীকে নিয়ে সমাজে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা তাদেরকে ডেকে ছিলাম কিন্তু আমাদের ডাকে সারা না দিয়ে উল্টো গ্রাম মাতব্বরদেরকে অসম্মান করেছে। একঘরে করার মত ঘটনা এখানে ঘটেনি, এগুলো গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
কালীগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (ওই ওয়ার্ডের) হেলাল উদ্দিন হেলু জানান, অনন্ত মিস্ত্রির বউকে নিয়ে কিছুদিন আগে একটুসমস্য হয়েছিল। এনিয়ে গ্রামের মাতব্বরা বিচার-শালিস করতে চাইলে অনন্ত মিস্ত্রি ও তার শ্বশুর কালীপদ বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় গ্রাম প্রধানেরা মিলে তাদেরকে একঘরে করেছে বলে আমি জেনেছি। এনিয়ে ওই গ্রামে দারুন অশান্তি বিরাজ করছে। আমি নিজে বিষয়টি সুরহার চেষ্টা করছি।
রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ এএসএম সিদ্দিকুর রহমান জানান, হরিপুরে একঘরে করার ঘটনা আমার জানা নেই, তবে আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।

সর্বশেষ সংবাদ