বাঙালীর সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হাজার বছরের ঐতিহ্য ‘ঢোল’

জিল্লুর রহমান শামীম: হাজার বছর পেরিয়ে আজও বাঙালীর লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গী ‘ঢোল’। অতি প্রচীন এই বাদ্যযন্ত্রের সম্পুরক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঠাই পেয়েছে বাঁশি, দোতারা, তবলা ও হারমোনিয়াম। তবে লোকগান, জারি- সারি, ভাটিয়ালি গানে এই ঢোল ছাড়া হয় না। বিয়ের গানে ও নাচনে ঢোল বাদন অন্যতম ভূমিকা পালন করে। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ধারায় ঢোলের আসন দখল করে নিচ্ছে ড্রাম। বিশ্বের রক ও জ্যাজ মিউজিকে যে ড্রামসেট ব্যবহার করা হয় তা আদি ঢোলেরই আধুনিক সংস্করণ। এই ড্রামগুলো নানা আকৃতিতে হয়ে থাকে জ্যাজ মিউজিক বেস, টম স্লায়ার এই তিন ধরণের ড্রামের সঙ্গে যে সেট বিন্যাস করা হয় তা আদি ঢোলের নকশা থেকেই নেয়া তার পরেও ঢোলের আবেদন আলাদা। সঙ্গীতশাস্ত্রে ঢোল আনন্দের বাদ্যযন্ত্র, তবে তার গভীরতা অনেক। লোকনাচে ঢোলের ব্যবহার তো আছেই, উৎসবের আয়োজনে ও আনন্দের বারতা পৌছনোর শুরুতে ঢোলই প্রধান অনুসঙ্গ। ঢোল-ছন্দ তালের বাদ্যযন্ত্র। ঢোল বাদন শেখানোর সময় হাতে একটি কাঠি দেয়া হয়। এই কাঠি দিয়েই বাদনের কয়েকটি পর্যায়ে ত্রিতাল, কাহারবা, দাদরা দ্রুত ও ধীর লয়ে বাজানো হয়। বাদন শুনে শ্রোতা-দর্শকদের অভিনন্দনের পাল্লা যত ভারি হয় ঢুলিরা তালকে দ্রুত লয়ে নিয়ে শরীরে ছন্দময় দুলুনি তোলে। যারা ঢোল বাজায় তারা ‘ঢুলি’ নামে পরিচিত। ঢুলিরা এতটাই এক্সপার্ট যে কখনও ঢোল মাটিতে রেখে কাঠির বদলে দুই হাতে বাজায়। শরীরের নানা ভঙ্গিমায় ঢোল মাথার উপর তোলে, আঙ্গিনায় নাফ-ঝাঁপ দিয়ে, কাঠি নানা কৌশল ব্যবহার করে বাহারি তাল তোলে। বাঙালী সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গে ঢুলিদের কদর ছিল। ডাক পড়ত। খেয়াঘাটের বটতলায় মাচাংয়ের ওপর বসে ঢুলিরা আপন মনেই ঢোল বাজাত। নবান্নের উৎসবে গ্রামের লোক বজরা নৌকা নিয়ে জ্যোৎ রাতে মাঝ নদীতে যেত। রাতভর ওই নৌকাতে বাজাত ঢোল। আওয়াজ শুনে বিভিন্ন গ্রামের লোকেরা নৌকা ঢুলি নিয়ে নদীতে নামতো। আনন্দের এমন জোয়ার এখন আর চোখে পড়ে না। তবে গ্রমীণ জীবনের আনন্দের ধারায় নৌকা বাইচে ঢোলের বাদনে মাঝিমাল্লাদের বৈঠার দ্রুততায় গতি বেড়ে যায়। লাঠি খেলার উদ্দীপনা আনতে ঢোল বাজানো হয়। গ্রামীণমেলায় ঢোলের ব্যবহার চিরন্তন। পুজো পার্বনে যাত্রাগানে, আনন্দ মিছিলে বৈশাখী অনুষ্ঠানে, পৌষ মেলা এবং শহরে বিভিন্ন আনন্দ র‌্যালিতে ঢোল অন্যতম অনুসঙ্গ। বাংলাদেশে ঢোল আগমন সম্পের্কে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অভিমত দিয়েছেন, ঢোল এসেছে মদ্যপ্রচ্য থেকে। মধ্যযুগে ঢোল এ দেশে সংস্কৃতিতে যোগ হয়েছে। আবার অনেকের মতে ভারতীয় উপমহাদেশে ঢোল উদ্ভাবন করেছিলেন ওস্তাদ আমীর খসরু। ঢোল যেভাবেই আসুক এটি যে লোকবাদ্যযন্ত্র তা সকলেই স্বীকার করেছেন। ঢোলের কদর বিশ্বজুড়ে।

সর্বশেষ সংবাদ