একযুগেও হলের দেখা পায়নি জবি শিক্ষার্থীরা

২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে একটি সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেলেও সুযোগ-সুবিধা পায়নি রাজধানীর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সাড়ে ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর সবাই থাকেন নিজ বাসা, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও মেস ভাড়া করে। এতে তাদের কষ্টের পাশাপাশি লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র জবির শিক্ষার্থীদের শতভাগই আবাসন সুবিধাবঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকে আবাসিক হলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। একযুগেও হলের দেখা পায়নি তারা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগের অভাবেই নতুন হল নির্মাণ ও তৎকালীন কলেজ আমলের বেদখল হওয়া হল উদ্ধার হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে।

জানা যায়, তৎকালীন কলেজের ১১টি বেদখল হলগুলো উদ্ধার ও নতুন হল নির্মাণের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রায় প্রতিবছরই আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের আন্দোলন কাজে আসেনি, এখনও একটি নতুন হল নির্মাণ হয়নি। তিনটি হল উদ্ধার হলেও ভবন নির্মাণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী বিলুপ্ত কলেজের সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ফার্মটির অনুসন্ধানে তৎকালীন কলেজের বেদখল হলগুলোর তথ্য বেরিয়ে আসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে হল উদ্ধারে বেশ কয়েকটি কমিটি করা হয়।

কমিটির নথিতে দেখা যায়, ২০০৯ সালে হলের দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলন হয়। এর প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও বেদখল অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধারে সুপারিশ করতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। মার্চে তদন্ত কমিটি আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেওয়ার সুপারিশ করে। ওই বছরের ৫ই মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলোর দীর্ঘমেয়াদি লিজের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। ভূমি মন্ত্রণালয় ওই বছরের ৯ই জুলাই অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। জেলা প্রশাসক ২০১০ সালের ২১শে জানুয়ারি আইনগত সুবিধার জন্য হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বলে জবি প্রশাসনকে। এর পরও হল না পাওয়ায় প্রতি বছর আন্দোলনে নামতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।

বর্তমানে বাণী ভবন হল, শহীদ নজরুল ইসলাম হল, ড. হাবিবুর রহমান হলের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে লিজ নিতে পারেনি। ফলে ওই জায়গায় স্থায়ী ভবন নির্মাণ করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জরাজীর্ণ বাণী ভবন হল এখন ‘কর্মচারী আবাস’ বানানো হয়েছে। এখানে প্রায় ৬০জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে বাস করছেন। ড. হাবিবুর রহমান হলের জায়গাটি দখলে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে প্রায় ১০জন কর্মচারী থাকেন। বেদখলে থাকা হলের মধ্যে তিব্বত হলটি এখন সাংসদ হাজি মোহাম্মদ সেলিমের মালিকানাধীন গুলশান আরা সিটি মার্কেটে মিশে গেছে। সেখানে ছাত্রাবাসের অস্তিত্ব আর নেই। অবশ্য হাজি সেলিম এটিকে তাঁর জায়গা হিসেবে দাবি করেন। প্রায় ২৬ কাঠা জায়গার ওপর আবদুর রহমান হল। সেখানে কয়েকটি পুলিশ পরিবারসহ ২২টি পরিবার বসবাস করে। শহীদ আজমল হোসেন হলেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। বজলুর রহমান হলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উচ্চবিদ্যালয় চলছে। শহীদ আনোয়ার শফিক হল, সাইদুর রহমান ও আবদুর রউফ হল এবং শহীদ সাহাবুদ্দিন হলটিও বেদখলে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে হল নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন জোরদার করলে ছাত্রাবাসগুলো উদ্ধারের লক্ষ্যে স্থানীয় সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বে কমিটি করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো জমি স্থায়ীভাবে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং ওই কমিটির সদস্য সচিব মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, কাগজপত্র না থাকায় আর দীর্ঘদিনের বিষয় হওয়ায় এটা অত্যন্ত জটিল কাজ। আমাদের চেষ্টার ঘাটতি নেই, সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

এদিকে ২০১২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের জমিতে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এক হাজার ছাত্রীর আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০তলা বিশিষ্ট দুটি টাওয়ার নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরের ২২শে অক্টোবর হলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালে হলটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে নির্মাণ কাজ চলছে। ভিত্তিপ্রস্তর ও নির্মাণ কাজের উদ্বোধনেই ২ বছর সময় লাগিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হলটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতে কত বছর লাগবে, এ প্রশ্ন অনেকের। হলের দাবিতে গত আগস্টে শুরু হওয়া ৩৩দিনের টানা আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রী হলের নির্মাণ কাজে গতি পেলেও বর্তমানে ‘কচ্ছপ’ গতিতে চলছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ছাত্রীহলটির নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

আবাসিক হল নির্মাণের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রায় ২৫ বিঘা জমি কিনেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে বহুতলবিশিষ্ট কয়েকটি হল নির্মাণ করে আবাসন সংকট অনেকটাই নিরসন করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অবশ্য এই জায়গায় ছাত্রদের জন্য একটি ২০ তলাবিশিষ্ট হল নির্মাণ প্রস্তাবিত রয়েছে। এই হলের প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অনুমোদন পেলে নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।

এছাড়া থার্মেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আ: কাদের মোল্লা ছাত্রদের জন্য এক হাজার আসনের একটি হল নির্মাণ করে দেয়ার কথা বলেছেন। ওই হলের নির্মাণকাজ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ উপলক্ষ্যে গত বছরের শেষের দিকে সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি। হলটির নির্মাণ নিয়েও শঙ্কায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ২০১২ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে তিনি দুটি হল নির্মাণ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ না করায় তিনি দুটি হলের জায়গায় একটি হল দিতে চেয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছার অভাবেই আবাসিক হল হচ্ছে না। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে অবশ্যই ১২ বছরে একটি হলেও আবাসিক হল নির্মাণ করা যেতো। এছাড়া একনেকে একটি ছাত্রহলের প্রকল্পের কথা ২ বছর ধরে শুনে আসছেন তারা। গত আগস্টে আন্দোলন থামাতে এ প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে তাদেরকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এ প্রকল্পটি আলোর মুখ না দেখায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফলতিকে দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা।

জবি শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের তথা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি ভাড়া করে কিংবা মেসে থেকে তাদের পড়ালেখা করতে হয়। একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে ব্যাচেলর বাড়ি ভাড়ার বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি। আবার অনেকেই দুর দুরান্ত থেকে এসে ক্লাস করেন। খুব ভোরে উঠে ক্যাম্পাসে রওনা দেন, আবার সন্ধ্যায় ফেরেন। এতে অধিকাংশ সময় বাসের মধ্যেই কাটাতে হয়। আবাসিক ব্যবস্থা থাকলে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেত শিক্ষার্থীরা।

ভিসি মীজানুর রহমান বলেন, জগন্নাথের আবাসন সমস্যার বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহল সজাগ ও সচেষ্ট। ইতিমধ্যে একটি ছাত্রী হলের নির্মাণকাজ চলছে। ছাত্রদের জন্য দুটি হল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। একনেকে অনুমোদন হলেই কেরানীগঞ্জে জবির নিজস্ব জমিতে ছাত্রদের হল নির্মাণের কাজ শুরু হবে। উদ্ধার হওয়া তিনটি হলের জায়গায় ছাত্রদের হল করার মতো কোনো পরিবেশ নেই। তা ছাড়া জায়গার পরিমাণও কম। পরবর্তী উন্নয়ন প্রকল্পে এসব জায়গায় শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ