বন্যার্ত মানুষের পাশে না দাঁড়ালে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা কি জবাব দেব-ফুলছড়ির ইউএনও

আরিফ উদ্দিন, গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃ নতুন দিনের শুভ সূচনা জানান দিচ্ছে পূব আকাশে রক্তিম সূর্য্যের উপস্থিতি। ঘড়ির কাটায় সাড়ে ৫টা। তখনো ভোরের কুয়াশা কাটেনি। গ্রামের মেঠোপথে প্রাত:ভ্রমনে বেরিয়েছেন হাল্কা মাঝারী গড়নের একজন মানুষ। কাছাকাছি যাওয়ার পর ভ্রম কেটে গেলো। তিনি ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু রায়হান দোলন। হাঁটতে হাঁটতে সদ্য সমাপ্ত একটি মেঝে পাকা ঘরের কাজ দেখছেন। তাঁকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না ষাটোর্ধ পারুল বেগম (ছদ্মনাম)। মাত্র ক’দিন আগেও থাকার ঘর ছিল না তার। কষ্টেসিষ্টে রাত কাটতো একটি ঝুঁপড়ি ঘরে। এখন তিনি একটি ঘরের মালিক। এই পথে একদিন হাঁটতে গিয়ে তার ঘরের দুরাবস্থা দেখে বিনা পয়সায় সরকারি একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেন ইউএনও। এভাবে প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে তার হাঁটার বদৌলতে পারুলের মত অনেকের দূর্দশা নজড় কাড়ার পর তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। পারুলের বাড়ি থেকে ফিরে আসলেন উপজেলার সরকারি কোয়ার্টারে। তখন সকাল সাতটা। বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানদের সাথে মোবাইলে কুশল বিনিময় শুরু। কোন দপ্তরের সমস্যা আছে কিনা প্রতিদিনের মতো ফোন করে খোঁজ খবর নিলেন। কথা শেষ হতে না হতেই ছেলে-মেয়েরা বই খাতা নিয়ে বাবার কাছে হাজির। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাবা-সন্তানের খুনসুটি। নাস্তার টেবিলে বসতেই বেজে উঠলো মোবাইল ফোন। কল ধরতেই ওপাশ থেকে কাঁপা কণ্ঠে এক নারী জানালেন রাত থেকে তার ঘরে খাবার নেই। ইউএনও তাকে আশ্বস্ত করে ফোন রাখলেন। কিছুক্ষণ পর তার বাড়িতে সাতদিনের খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা হয়ে গেলো। করোনাকালের শুরু থেকেই ইউএনও কর্মহীন দরিদ্রদের সহায়তার জন্য একটি ফুডব্যাংক (খাদ্য ভান্ডার) স্থাপন করেছেন। যে খাদ্য ভান্ডার থেকে এ পর্যন্ত তিন সহস্রাধিক মানুষকে চাল, ডাল, তেল, লবন, আলুসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে। উপকার ভোগীদের তালিকা থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত এ কাজ গুলো করতে তাঁকে সহায়তা করছে ফুলছড়ি ভলান্টিয়ার্স নামে একটি ফেসবুকগ্রুপের দেড় শতাধিক ভলান্টিয়ার। নাস্তা সেরে সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে হাজির। অফিসে এসে ডাকফাইল দেখে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইলে স্বাক্ষর করে কলিংবেল চাপতেই কর্মচারীদের হাজিরা খাতা নিয়ে আসলেন অফিস সহায়ক। কোন কর্মচারী অনুপস্থিত আছেন কিনা দেখে নিলেন। সকাল দশটা, একজন বিধবা মহিলা অনুমতি নিয়ে অফিসের ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়ে বিধবা ভাতার জন্য অনুরোধ করলেন। লোকমুখে তিনি শুনেছেন বিনা পয়সায় ইউএনও’র বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ড করে দেয়ার সংবাদ। তাই তিনিও এসেছেন। বিধবা মহিলার নিকট থেকে পারিবারিক অবস্থার বিবরণ শুনে নতুন বরাদ্দ সাপেক্ষে তার ভাতার কার্ড দেয়ার আশ্বাস দিলেন ইএনও দোলন। সকাল সাড়ে দশটা। বন্যা কবলিত ব্যক্তিদের মাঝে ত্রাণ বিতরন করতে বের হলেন অফিস থেকে। ছুটে গেলেন ত্রাণ বিতরণে। স্পিডবোটে করে নদী ভাঙ্গনের শিকার লোকদের খোঁজ নিতে ছুটে গেলেন এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নে। প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে অফিসে ফিরতে বেলা দুপুর গড়িয়ে গেল, ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই। ছুটে গেলেন জেলা সদরে আসন্ন বন্যা মোকাবেলায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়। সভা শেষে উপজেলায় এসে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা। করোনাকালে উপজেলায় কর্মরত অফিসারদের নিয়ে কিছু কিছু সভা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুরু করেছেন তিনি। করোনার ফলে সম্প্রতি এ উপজেলায় কর্মরত অফিসারদের নিয়ে একটি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারগ্রুপও তৈরি করা হয়েছে। অফিসারদের যে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিলে এই গ্রুপে আলোচনা করে সমাধান করা হয়। এছাড়া করোনায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে জুম অ্যাপের মাধ্যমে মিটিং করেন ইউএনও। সাড়ে তিনটার মধ্যে মিটিং শেষ করে নেমে পড়লেন মোবাইল কোর্টে। অনেক প্রচার প্রচারনা এবং সচেতনতার পরও যারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না তাদের অনেককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আনলেন শাস্তির আওতায়। মোবাইল কোর্ট শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অফিসের চেয়ারে বসলেন। অনেক গুলো ফাইল এসে হাজির। এমন সময় খবর আসলো ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যাপক হারে বাড়ার কারণে বাঁধের কয়েকটি জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার পর নিজে গিয়ে বাঁধের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করলেন। এসময় বাঁধে আশ্রিতদের খোঁজ-খবর নিয়ে উপজেলা কমপ্লেক্সে ফিরতেই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ফোন। যেতে হবে করোনা আক্রান্তদের বাড়ি লকডাউন করতে এবং তাদেরকে আইসোলোশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রফিকুজ্জামান ও ফুলছড়ি থানার ওসি কাওছার আলীকে সাথে নিয়ে লকডাউন বাস্তবায়নের পর বাসায় ফিরতে ফিরতে সূর্য্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যেতে বসেছে। বাসায় ফিরে মুখ হাত ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেন রাত সাড়ে সাতটার মধ্যে। কারণ তিনি দুপুরের খাবার খান না। রাতের খাবার খেয়ে আধাঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে রাত সাড়ে আটটায় আবার কাজে নেমে গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা কর্মসূচির তালিকা সংশোধনের কাজ তদারকি করতে। সেখান থেকে বাসায় ফিরলেন রাত এগারোটায়। এরপর ঘুমানোর পালা। আবু রায়হান দোলন ৩০ তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর কর্মদক্ষতায় পদোন্নতি নিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ই অক্টোবর ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের জনক। তাঁর বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ভাংনী গ্রামে। রোববারের (১২ জুলাই) মতো প্রায় প্রতিটি দিনই সূর্যোদয় থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোভিড-উনিশের বিরুদ্ধে একজন ইউএনও’র সংগ্রামের এই যুদ্ধ প্রায় প্রতিদিনের। ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসেবে করোনার শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিন এভাবেই অদৃশ্য শত্রু করোনা জয়ের আশায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আবু রায়হান দোলন। তিনি আমাদের গাইবান্ধাকে বলেন, সব সময় মানুষের সেবা করার সুযোগ পাওয়া যায়না। মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত হয় তখন সামনে খড়কুটো পেলেও আকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। করোনা কিংবা বন্যার মতো দূর্যোগ সব সময় আসেনা। বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এটাই মোক্ষম সময়। এখন মানুষের পাশে না দাঁড়ালে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা কি জবাব দেব। যার যতটুকু সামর্থ আছে, তাই নিয়ে সবাই এগিয়ে আসলে একদিন সব অন্ধকার কেটে যাবে, আমরা আলোর মশাল উর্দ্ধে তুলে বলতে পারবো জয়-মানবতার জয়।

সর্বশেষ সংবাদ