পবিত্র কোরআনের আলোকে সদাকা ও রুযী হতে ব্যয়

মহান আল্লাহ সুবহানুতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। যার অন্যতম দায়িত্ব হল সৃষ্টির প্রকৃত কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। আর তাই মানুষকে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা সর্বোত্তম অবয়বে তৈরী করেছেন, দিয়েছেন চোখ, জিহ্বা, ঠোট; দেখিয়েছেন দুইটি পথ। নানান নিয়ামত (সন্তান, সম্পদ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সক্ষমতা ইত্যাদি) দিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য কে সৎকর্মশীল। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারাই সৃষ্টির সেরা।

সৎকর্মশীলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা সচ্ছলতা ও অভাবের সময় ব্যয় করে, রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা হয় ক্ষমাশীল। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা পবিত্র কোরআনে যা কিছু নির্দেশ করেছেন সবই ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সব আদেশকে আমরা নফল বানিয়ে ফেলি এবং পালনের জন্য মনগড়া নানা শর্ত তৈরী করি। সদাকা ও রুযী হতে ব্যয় তেমনই একটি বিষয় যা মূলত ফরজ। তবে আমরা মনে করি নফল।

মহান আল্লাহ সুবহানুতায়ালা সদাকা রুযী হতে ব্যয়কে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন– 

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।
সদাকা হল কেবল ফকির, মিসকীন, তদসংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন; দাস-মুক্তির জন্যে, ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে; এই হল বিধান (আরবীতে ফারিদা)। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তওবা আয়াত-৬০)

সদাকার এত গুরুত্ব যে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে মানুষ সালাত, সিয়ামের বা হজের জন্য আফসোস না করে বরং সদাকা করার জন্য পুনরায় পৃথিবীতে আসার জন্য প্রার্থনা করবে।

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।

আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদাকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত হতাম। (সুরা মুনাফিকুন আয়াতঃ ১০)

“হে ঈমানদারগণ আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেই দিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারীশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই প্রকৃত যালীম ।” সূরা বাকারা আয়াতঃ ২৫৪।

পবিত্র কোরআন অনুসারে সদাকা এবং রুযী হতে ব্যয় করা মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।
এ সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। হেদায়েত মুত্তাকীদের জন্য যারা অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে। (সুরা বাকারা আয়াতঃ ২-৩)

সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং সৎকর্ম হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহে, কিয়ামত দিবসে, ফেরেশতাতে এবং সমস্ত নবী-রাসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকীন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা পালনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই মুত্তাকী।(সুরা বাকারা আয়াতঃ ১৭৭)

পবিত্র কোরআনে সম্পদ সঞ্চয়কে কঠিন ভাবে নেরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং এর পরিণাম বলা হয়েছে জাহান্নাম– 

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।
হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখতে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জামা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে, এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এখন আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার কারণে। (সুরা তওবা আয়াতঃ ৩৪, ৩৫)

পবিত্র কোরআনে সম্পদ দানকে যে ভাবে উৎসাহিত (৭০০ গুন পর্যন্ত সওয়াব) করা হয়েছে অন্য কোনো কাজকে ভাবে করা হয়নি–  

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।

“যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে এবং আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন বর্ধিত করেন। আল্লাহ অতি দানশীল।”  (সুরা বাকারা আয়াতঃ ২৬১)

মানুষ কি সদাকা/ব্যয় করবে?
কোরআনে বলা হয়েছে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু হতে ব্যয় কারার জন্য, নইলে তা গৃহীত হবে না,কিন্ত আমাদের ধারনা ও প্রচলন এর বিপরীত- “হে ঈমানদারগণ! তোমার স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্ত ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্হ করো না। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে না নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাব মুক্ত, প্রশংসিত।” সূরা বাকারা আয়াতঃ ২৬৭।

“কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্ত থেকে ব্যয় না কর। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন।” (সুরা আল ইমরান আয়াতঃ ৯২)

“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্হাপন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় কর। অতএব, তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও ব্যয় করে তাদের জন্য আছে মহা পুরুস্কার।” (সুরা হাদিদ আয়াতঃ ৭)

কখন সদাকা/ব্যয়/দান করতে হবে?
এটা করতে হবে ফসল আহরণ ও সম্পদ অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই ( ফসল কাটার দিন, বেতন পাবার দিন, ব্যাবসার লাভ করার দিন) এক বছর বা নির্দিষ্ট সময় পরে নয়।

“তিনিই উদ্যান সমূহ সৃষ্টি করেছে এবং খর্জুর বৃক্ষ ও শস্যক্ষেত্র বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট এবং যয়তুন ও আনার- এগুলো একে অন্যের সাদৃশ্যপূর্ণ এবং সাদৃশ্যহীন। এসব ফল খাও, যখন ফলন্ত হয় এবং হক দান কর কর্তনের সময়ে এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না।” (সুরা আনআম আয়াতঃ ১৪১)

কাদের জন্য সদাকা/দান/ব্যয় করতে হবে
“লোকে কি ব্যয় করবে সে সমন্ধে প্রশ্ন করে। বল ”যে ধন সম্পদ তোমরা ব্যয় করিবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন এবং মুসাফীরদের জন্য। উত্তম কাজের যাহা কিছু তোমরা কর না কেন আল্লাহ তো সে সম্পর্কে অবহিত।” (সুরা বাকারা আয়াতঃ ২১৫)

“সদাকা হল কেবল ফকির, মিসকীন, তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক; তা দাস-মুক্তির জন্যে, ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান (আরবীতে ফারিদা)। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা তওবা আয়াতঃ ৬০)

কতটুকু সদাকা/দান/ব্যয় করতে হবে?
এই বিষয়টি আল্লাহ ব্যক্তির উপর ছেড়ে দিয়েছেন, তবে কিছু নীতিমালা আল্লাহ দিয়েছেন তা হল; ব্যবহার বা প্রয়োজন মেটানোর পর যা থাকবে তাই সৎকাজে ব্যয় করবে, নিজেকে দারিদ্রতার মধ্যে ফেলতে নিষেধ করেছেন, অন্যত্র বলা হয়েছে ব্যয়ের বিষয়ে মধ্য পন্থা অবলম্বন করতেঃ

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।

“লোকে তোমাকে জিজ্ঞেস করে কি তাহারা ব্যয় করিবে? বল, যাহা উদ্ধৃত। এইভাবে আল্লাহ তাহার বিধান তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করেন যাহাতে তোমরা চিন্তা কর।” (সুরা বাকারা আয়াতঃ ২১৫)

“ব্যয় কর আল্লাহর পথে তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না।  আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালবাসেন।” (সুরা বাকারা আয়াতঃ ১৯৫)

সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও মানুষ সদাকা ব্যয়ের বিষয়ে যে কার্পন্য করবে সে বিষয়টি কোরআনে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন–  

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।

“মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অর্শ্ব, গবাদি পশুরাশি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়স্থল।” (সুরা আল ইমরান আয়াতঃ ১৪)

“নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ। সে অবশ্য এ বিষয়ে অবহিত এবং সে নিশ্চিতই ধন-সম্পদের ভালবাসায় মত্ত।” (সুরা আদিয়াত আয়াতঃ ৬-৮)

“প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে বিপথগামী রাখে, এমনকি, তোমরা কবরস্থানে পৌছে যাওয়া পর্যন্ত। এটা কখনও উচিত নয়। তোমরা সত্ত্বরই জেনে যাবে।” (সুরা তাকাসুর আয়াতঃ ১-৩)

আমাদের মধ্যে অনেকেই সদাকাও দান করে কিন্ত তা বলে বেড়ায় এবং এর মাধ্যমে দান বিনষ্ট হয়ে যায়। সৃষ্টির সেরা হওয়ার জন্য সুন্দরতম অবয়ব ও অন্য সকল গুণাবলী সম্পন্ন তৈরী করা সত্যেও অধিকাংশ মানুষ দুনিয়ার প্রতি ঝুকে পড়ে ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর এমন মানুষের তুলনা কুকুরের ন্যায়।

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম।

“কিন্তু  যে অধঃপতিত এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে রইল। তার অবস্থা হল কুকুরের মত; যদি তাকে তাড়া কর তবুও হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও তবুও হাঁপাবে। এ হল সেসব লোকের উদাহরণ; যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে আমার নিদর্শনসমূহকে। অতএব, আপনি বিবৃত করুন এসব কাহিনী, যাতে তারা চিন্তা করে।” (সুরা আরাফ আয়াতঃ ১৭৬)

আমরা যেন সত্য জ্ঞানের আলোকে সদাকা, রুযী হতে ব্যয় এবং দানের মাধ্যমে যথাযথ উপকৃত হতে পারি। আমিন।

সর্বশেষ সংবাদ