আকবরিয়ার দই মিশে আছে ভোক্তাদের প্রাণে প্রাণে

বগুড়ার কোন ভোজ উৎসবের তালিকায় দই নেই এমন কেউই ভাবতে চান না। হোক সে অতি দরিদ্র কিংবা শহরের অতি বিলাসী পরিবার। অতিথি আপ্যায়নে কিংবা প্রিয়জনের মন ভুলাতে বগুড়ার দই’র বিকল্প নেই। বগুড়ার দই দিন দিন হয়ে উঠেছে আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। শুধু দইকে কেন্দ্র করেই বগুড়া পেয়েছে নতুন পরিচিতি।
বগুড়াকে দই’র শহর বলা হয়। বগুড়ার প্রবীণরা জানান, দইয়ের শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। কথিত আছে, উনিশ শতাব্দীর ৬০ এর দশকের দিকে গৌর গোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ি প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারনা ছিলোনা। গৌর গোপালের এই দই’ই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারের কাছে এ দই সরবরাহ করতেন গৌর গোপাল। সে সময়ে এই দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। নবাবী আমলে বিশেষ খাবার ছিল এই দই। কালে কালে দিন গড়িয়ে গেলেও এখনো বিশেষ খাবার হিসেবে ধরে রেখেছে দই। বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, আকিকা, হালখাতা বা পারিবারিক যে কোন অনুষ্ঠানে দই হলো বিশেষ খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এরপর বগুড়ার শতাব্দীর স্বাক্ষর আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট ষাটের দশকেই দই তৈরীতে নতুন করে সূচনা করে। সরার পাশাপাশি ডুঙ্গি (মাটির তৈরী বিশেষ ধরনের পাত্র) ও পাতিলেও দই তৈরী করে বিক্রি শুরু করলেন। ষাটের দশকের পর আকবরিয়া হোটেলের দই স্বাদের পরিবর্তন করে বিপ্লব ঘটায়। মানসম্মত দই তৈরী করে আকবরিয়া হোটেলও এগিয়ে গেল। মিষ্টি ও সাদা দইয়ের প্রচলন হয়ে গেল। বগুড়ার ভোক্তারা আকবরিয়ার দইয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়লো। চাহিদা বেড়ে গেলে তখন জেলার গন্ডি ছেড়ে আশপাশের জেলাতেও দইয়ের প্রচলন হতে থাকে। স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। নামে বেনামে সেসব প্রতিষ্ঠান বগুড়া শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠে। আকবরিয়া হোটেলের দই কারিগররা তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে দই তৈরী করে বিক্রি শুরু করে। মুলত আকবরিয়ার কারিগর ও তাদের সহকারি এখনো বগুড়া শহরের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে দই ও মিষ্টি তৈরীতে কাজ করে যাচ্ছে। দই তৈরী ছড়িয়ে পড়লে জেলা শহরের গৌর গোপালের পাশাপাশি মহরম আলী, বাঘোপাড়ার রফাত আলী ও দইঘরসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আকবরিয়া হোটেল সবাইকে ছাড়িয়ে নানা নামের দই তৈরী করে বাজারে হাজির হয়। সে সব দইয়ের স্বাদ ও মান অতুলনীয় হয়ে উঠায় আকবরিয়া হোটেলের দই আবারো সেরার সেরা হয়ে উঠে। আকবরিয়া হোটেল থেকে এবার অতুলনীয় স্বাদ নিয়ে স্পেশাল দই, শাহী দই, মালাই দই, খেজুরের গুড়ের দই, মজলিস দই, পপুলার দই, সাদা ও টক দইসহ হরেক রকম দইয়ের পসরা নিয়ে সাজালেন বাজার। এতেই অভাবনীয় সাফল্য ছুঁয়ে গেল আকবরিয়া হোটেলকে। যত দিন যাচ্ছে আকবরিয়া হোটেল তার সকল পণ্যের মান বৃদ্ধি করার ফলে এখনো রাজকীয়ভাবে টিকে আছে আকবরিয়ার নাম ও সুনাম। শহরে হরেক নামের দই ও মিষ্টি পাওয়া গেলেও এখনো আকবরিয়া হয়ে আছে মানের সেরা। জেলা ও জেলার বাহিরে অন্যান্য জেলাতেও আকবরিয়ার দই পাওয়া যায় নিয়মিত। এমনকি ঢাকাতেও সেরা মানের দই বিক্রি করছে আকবরিয়া। সেখানেও রয়েছে প্রচুর চাহিদা।
আকবরিয়ার দই তৈরীর কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দই তৈরীতেও রহস্য এক ধরনের দক্ষতা। দক্ষতা ছাড়া ভাল মানের দই তৈরী করা যায় না। দই তৈরীর মুল উপকরণ হলো ভাল মানের দুধ। দুধ যত ভাল মানের হবে দই তত স্বাদের হবে। দই তৈরীর কাজে বিশেষ দক্ষ কারিগর না হলে উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়।
আকবরিয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, তাদের দই দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে তারা যে প্যাকেটে দই দেন তা শীতকালে থাকে ৪/৫ দিন। আর গরম কালে থাকে ২/৩ দিন। উত্তরাঞ্চলে কোন বিদেশি বেড়াতে এলে তারা ফেরার সময় দই কিনে নিয়ে যান। হাতে হাতে করেই এই দই পৌছে যায় ভিন্ন দেশে। আকবরিয়ার দইয়ের চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে দই নিতে অর্ডার দিয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার এই বাজারে দইয়ের মান টিকে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে নিম্নানের দই’এর ভীড়ে বেশি ঝামেলা হয়। আবার দাম কমিয়ে দই’এর গুনগত মান ঠিক রাখাও যায়না।
বগুড়ার আকবরিয়া দই মিষ্টি বিভাগের ডিজিএম আলমগীর হোসেন জানান, বিভিন্ন ব্রান্ডের দই পাওয়া যায় বগুড়ায়। কিন্তু আকবরিয়ার দই বর্তমান বাজারে সেরা দই হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্রে দই ভরানো হয়। আগে কেজি হিসেবে দই বিক্রি হলেও এখন উপকরনের মূল্য বৃদ্ধি হবার কারনে দই বিক্রি হয় প্রতি পিছ হিসেবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ বগুড়া এলে এখানকার দই’র স্বাদ নিয়ে থাকেন। দই তৈরীর যাবতীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে দিগুণ এ কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে। শো রুমে বিভিন্ন স্বাদের দই পাওয়া যায়। মিষ্টি দইয়ের পাশাপাশি বিক্রি হয় টক বা সাদা দইও।

বগুড়ার কথা উঠলে মহাস্থানগড়। আর এখানে এসে খাবারের কথা উঠলেই আকবরিয়া লিমিটেডের দই। আকবরিয়া হোটেলের দইয়ের কোন বিকল্প নেই। আকবরিয়া দইয়ের স্বাদ না নিয়ে বগুড়া ছেড়ে যাওয়া খুব কষ্টসাধ্য বিষয়। প্রিয়জন বা অতিথি আপ্যায়নে আকবরিয়া দইয়ের বিকল্প নেই। আকবরিয়া দই স্বাদে ও মানে এখন অতুলনীয় হওয়ায় দিন দিন আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আকবরিয়া দই মিশে আছে ভোক্তাদের প্রাণে প্রাণে।

সর্বশেষ সংবাদ