ড্যান্ডির নেশায় নষ্ট হচ্ছে হাজারো পথশিশুর জীবন

এম কে রায়হান: যে বয়সে বই হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে জীবিকার সন্ধানে বস্তা হাতে নিয়ে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভাঙারি হিসেবে পরিচিত ফেলে দেয়া বস্তু। এসব বিক্রি করে চলে তাদের জীবন সংসার।

ওদেরও স্বপ্ন আছে, আছে ইচ্ছা ও সাধ। তবে কঠিন বাস্তবতা ওদের করেছে বিপথগামী। ওরা বেশিরভাগই পিতামাতা ও অভিভাবকহীন। পরিবেশ ও সমাজের অনেকেই ওদের দেখে ভিন্নচোখে।

লাল লাল চোখ, অগোছালো চুল। ছেড়া গেঞ্জি ও ময়লাযুক্ত প্যান্ট পরে বসে আছে রেল লাইনের বস্তির পাশে। কখনো দলবদ্ধ হয়ে আবার কখনো একাকি।

রাজধানীর তেজগাঁও রেল গেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেল আলো আঁধারের মাঝে পথশিশুদের অন্ধকার জীবনের অন্য দিক। এখানেই অনেক শিশুকে এক হয়ে এক ধরনের আঠা দিয়ে নেশা করতে দেখা গেলো। তাদের মধ্যে ছিল ছয়জন। ওদের বয়স ছয় থেকে ১০ বছরের মধ্যে। ওদের কাছে এ আঠার নেশা ড্যান্ডি নামে সমধিক পরিচিত।

ওদের কাছে এ নেশা করার কারণ জানতে চাইলে বিপ্লব নামের একজন বলে, ‘এ আঠা নাকে গেলে মাথা ঝিম ঝিম করে, ঘুম আহে। সবকিছুর কষ্ট ভুইল্যা যাই। বাবা-মা হারানোর কষ্ট ভুইল্যা যাই।’

শিপন নামের আরেক শিশু নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলে, ‘আমার মা-বাপ নাই। ছোট বেলা থ্যাক্কাই বড় হইসি এই রেললাইনে। সবাই এইডা করত তাই আমিও করি। এহন না করলে ভালো লাগে না।’

সরেজমিনে দেখা গেছে পথশিশুরা গাঁজা, সিরিঞ্জ, ঘুমের অষুধ, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে এবং পেট্রল শুকে নিয়মিত নেশা করে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্ত্বর, চানখারপুল, সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় এসব নেশাগ্রস্ত পথশিশুদের।

রাজধানীতে পথশিশুর সংখ্যা কত, তাদের মধ্যে কত জন মাদকে আসক্ত সেই পরিসংখ্যান নেই সরকারি দপ্তরে। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর জরিপে নানা সময় যে তথ্য উঠে আসে, তাতে দেখা যায় পথশিশুদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু নানা রকম মাদক নেয়।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে শিশু ও কিশোর মাদকসেবীর সংখ্যা তিন লাখ ২৪ হাজার এদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই হলো পথশিশু।

দিন দিন ওই সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন অপরাজেও বাংলাদেশ এর সহকারি পরিচালক মুস্তফা রহমান। তিনি নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলেন, ‘যে সকল পথ শিশু নেসায় আসক্ত তাদের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এসকল শিশু সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে যাত্রীদের বোঝা বহন করে যে টাকা আয় হয় তারও একটা বড় অংশ ব্যয় হয় মাদকের পেছনে। আর মাঝে মাঝে মাদকাসক্ত এসব শিশু নেশার টাকা জোগাড় করতে অনেক সময় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।’

শিশুদের নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন অভিযাত্রিক বাংলাদেশের পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ জ্যামি নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলেন, ‘সরকার এই শিশুদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগের কথা বললেও এর সুফল কমই মিলেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে আরও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নুরুল কবির নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলেন, ‘আজকের এই পথশিশুরাই একদিন বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে পরবে। কারণ নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা সবকিছুই করতে পারে। এমনকি মানুষ হত্যাও। এদের দ্বারা সমাজ নিরাপদ নয়। সমাজকে নিরাপদ করতে হলে আর এই শিশুদেরকে খারাপ নেশার কবল থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই শিশুরা আজ পরিস্থিতির স্বীকার। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর পাশাপাশি সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’

সর্বশেষ সংবাদ