দীর্ঘ ৫০ বৎসর চিকিৎসা সেবা দিয়েও আজ পর্যন্ত পাননি কোন সংবর্ধনা বা সম্মাননা

শাফায়াত সজল, বগুড়া প্রতিনিধিঃ মাটির ছোট্ট একটি ঘর। সন্ধ্যা সবে নামলো। ঘরের একটা জানালা, ১টা দরজা। ঘরের মধ্য কাঠের ১টি টেবিল, ৩টি চেয়ার এবং ১টি কাঠের বেঞ্চ পাতানো। কাঠের টেবিলের উপরে টিপটিপ করে জ্বলছে হারিকেনটি। টেবিলের এক পাশের চেয়ারে বসে আছেন এক ব্যক্তি, গলাতে ঝুলানো স্টেথোস্কোপ। অন্যপাশের ২টি চেয়ার আর কাঠের বেঞ্চ গুলোতে বসা কিছু পুরুষ ও মহিলা। সবাই এসেছেন চিকিৎসা নিতে। আর হারিকেনের আলোয় ডাক্তার সাহেব ব্যস্ত রুগী দেখতে ও রোগের ধরণ বুঝে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রেসক্রিপশন লিখতে। এমনভাবেই বিড়বিড় করে নিজের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ১৯৭৫ সালের কথা। যিনি রুগী দেখছিলেন ওনার নাম আবুল ফজল। এলাকায় তিনি ল্যাংড়া ডাক্তার নামেই বেশি সুপরিচিত। পেশায় তিনি একজন পল্লী চিকিৎসক। যিনি প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যখন আধুনিক চিকিৎসা ও ডিগ্রীধারী ডাক্তারদের প্রকট অভাব তখন এই আবুল ফজলদের মত গ্রাম্য ডাক্তারেরাই ছিলেন সকলের শেষ ভরসা। আজকের গল্প এই মহান ব্যক্তিকে ঘিরেই। যিনি তার জীবনের পুরোটা সময় মানবতার সেবায় ব্যয় করেও জীবনের শেষ  প্রান্তে এসেও আজ পর্যন্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পাননি কোন সম্মাননা, স্বিকৃতী বা সংবর্ধনা।
স্থানীয়সুত্রে জানা যায়, বগুড়া সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের দশটিকা ডাক্তার পাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৫০ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আবুল ফজল। তার পিতার নাম মৃত দানেশ উদ্দীন। পেশায় তিনিও একজন পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। মায়ের নাম জমেনা বিবি। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্য আবুল ফজল ছিলেন বড়। তার বাবা ডাঃ দানেশ উদ্দীন ছিলেন ৬০ থেকে ৭০ দশকের সময়ের প্রখ্যাত পল্লী চিকিৎসক। যেসময় চিকিৎসার অভাবে মানুষ মারা যেতো। তখন তিনি ঘোড়ায় চড়ে পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা সেবা দিতেন। তার পুত্র আবুল ফজল নুনগোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেনী পাশ করেন, নুনগোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন এবং ১৯৬৮ সালে বগুড়ার তৎকালীন ফুলবাড়ীস্থ নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। আশপাশের এমন কোন গ্রামের মানুষ নেই যে ৮০ ও ৯০ দশক পর্যন্ত আবুল ফজলের চিকিৎসা সেবা নেননি।
মরহুম পিতার কাছ থেকেই মূলত তিনি চিকিৎসা পেশায় আসেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ঘোড়াতে চড়ে গ্রামে গ্রামে যেতেন রুগী দেখতে। পিতার উৎসাহে তিনি ১৯৭৪ সালে এলএমএফ (LMF) ১ বছর মেয়াদী গ্রাম্য ডাক্তারের উপরে কোর্স করেন এবং কোর্স শেষ করে তৎকালীন নুনগোলা হাটে মাটির ঘরে চেম্বার বানিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি সাহেরা বেগম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। উল্লেখ্য, তারা সেসময়ে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে করে।
সংসার জীবনে ডাঃ ফজল ২ পুত্র সন্তানের জনক। বড় সন্তান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন এবং ছোট পুত্র একটি কলেজের প্রভাষক হিসাবে কর্মরত আছেন। তার পুত্রবধুরাও উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো নিশিন্দারা ইউনিয়নে বিভিন্ন সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন থাকার পড়েও তাকে কোন সংগঠনই এখন পর্যন্ত নুন্যতম সম্মাননা, সংবর্ধনা কিংবা স্বিকৃতী দেয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও নেওয়া হয়নি পদক্ষেপ।
এতদিনের চিকিৎসা সেবা দিয়ে কি পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি কোন কিছু পাওয়ার আশায় এই পেশায় আসিনি। আমি শুধু মানুষকে সেবা দেওয়াটাই বড় মনে করেছি। আমার এখনো অনেক টাকা বাকী পড়ে আছে মানুষদের কাছে তবুও আমি কিছু মনে করিনা, তবে জীবনের দীর্ঘ এতটা সময় যে পেশায় ব্যয় করেছি কিন্তু কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমাকে নুন্যতম সম্মাননা টুকুও জানালো না এইটা মনে হলে অনেকটা কষ্ট পাই, খারাপ লাগে। কিন্তু যখন ভাবি আমার চিকিৎসা সেবা পেয়ে আজ পর্যন্ত কোন রুগীর ক্ষতি হয়নি, উচ্চ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে আমি হাসপাতালে যেতে বলতাম, তারা যখন সুস্থ হয়ে আসতো তখন আমার চেয়ে সুখী ও আনন্দিত কেউ হতো না। তবে সংবর্ধিত হতে, সম্মাননা পেতে কার না ভাল লাগে।আমার এই সমাজের প্রতি যেটুকুই অবদান তারই যদি প্রতিফলন হলো অন্তত জীবনের শেষ দিনে এসেও মানসিকভাবে শান্তি পেতাম, ভাল লাগতো”।

সর্বশেষ সংবাদ