হৃদয়ে চলন: চলনবিল বলনবিল আনিফ রুবেদ

 

কেউ কেউ বলে থাকেন  দেশে কবির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এরকম নাক উঁচু টাইপ লোকের অভাব নেই। কেউ কেউ কাক আর কবির সংখ্যার একটা পরিসংখ্যান দিতে চান। তবে দুঃখ, এধরনের কথার বেশিরভাগটা আসে কবি লেখকদের ভেতর থেকেই।

আমার গভীরতম বোধ থেকে মনে হয় Ñ একটা কবিতা লেখা এবং একটা কবিতা পাঠের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। একটা গান শোনা এবং গান গাওয়ার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। অন্তরের গভীরের কোনো এক জায়গাতে ব্যাপারটা একই। কবিতা লিখে বা গান গেয়ে নিখাদ এক আনন্দ পাওয়া যায়। কবিতা পড়ে বা গান শুনেও দারুণ এক আনন্দের ভেতর দিয়ে যাই।

পৃথিবীতে আটশ কোটি মানুষ তাদের মধ্যে কজন কবিতা লেখেন? সংখ্যাটা খুবই কম। আমারতো বাসনা জাগে আটশ কোটি মানুষই কবিতা পড়বে, লিখবে, গান গাইবে বা গান শুনবে অর্থাৎ শিল্প মাধ্যমের কোনো একটা বা একাধিকের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকবে। না, তাকে টলস্টয় বা রবীন্দ্রনাথ হবার দরকার নেই। তাকে বব ডিলান বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হবার দরকার নেই। সে নিজে আনন্দ পেলে আর দশ বিশ জনকে আনন্দ দিতে পারলে, গভীর বোধের ভেতর নাড়া দিতে পারলেই হলো। তাও যদি না পারে নিজে আনন্দ পেলে এবং সময়টুকু সেই কাজে ব্যয় করতে পারলেই সার্থক।

মানুষ ছুটছে টাকার পিছে। মানুষ খুন করার জন্য ছুটছে, খুন হওয়া থেকে বাঁচার জন্য ছুটছে। মানুষ ধর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে অন্যজন ধর্ষিত না হবার জন্য কোন গর্তে ঢুকবে তা খুঁজে পাচ্ছে না। গু-ামী মাস্তানি করার, করতে পারার একটা প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। সেখানে একটা লোক কবিতা লিখবে, গান গাইবে এতে গা জ্বালা করার কোনো কারণ নেই। তাতে তার কবিতা, তার গাওয়া যত নি¤œমানেরই হোক না কেন? নিশ্চয়ই একদিন সে ভালো করবে।

পত্রিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এসব কথা বলা হয়ে গেল। বলা হলো তার কারণও আছে। এই প্রচুর সংখ্যাক পত্রিকা বের হওয়া নিয়েও একই ধরনের মানসিকতার কথা মাঝে মাঝেই উঠে। প্রশ্ন ওঠে মান নিয়েও।

যখন দিকে দিকে জোরজবরের জয়, টাকাকে নিজের অঙ্গের মত মনে করা, ধর্ষণ আর খুনকে বীরেরভাবে নেওয়া, গু-ামি, মাস্তানি, ভ-ামির জয়জয়কার, নেশা করে মাতলামি ছিনতাই করা প্রভৃতির রাজ্য তখন একটা লোক কবিতা লিখছে, যদিও সে জানে এতে তেমনকোনো লাভ নেই, কোনো একটা লোক গান গাইছে, পত্রিকা করছে যদিও জানে এতে কোনো লাভ নেই। তারপরেও করছে। এটাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত।

একটা পত্রিকা করা খুব সহজ কাজ নয়। তাতে যে ধরনের, যে মানেরই পত্রিকা হোক না কেন।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা থেকে একটা পত্রিকা বের হচ্ছে। নাম, হৃদয়ে চলন। নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জের বিশাল বিস্তার নিয়ে বিখ্যাত চলনবিলের অবস্থান। এই চলনবিলকে, চলনবিলের মর্মকে, চলনবিলের দর্শনকে বুকে ধারণ করেই প্রকাশ হচ্ছে হৃদয়ে চলন। পত্রিকাটির সম্পাদক হাদিউল হৃদয়। তিনি একজন কবি।

হৃদয়ে চলনের মোট সংখ্যা বের হয়েছে পাঁচটি। আর পাঁচটি সংখ্যাই পড়ার সুযোগ ঘটেছে। এই পাঁচটি সংখ্যার পাঁচটি শরীরের দিকে আলাদা আলাদা করে তাকালে পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়। এক সংখ্যা থেকে আরেক সংখ্যা ক্রমে উন্নতি লাভ করেছে। শরীরে এবং ভেতরের বস্তুতে।

প্রথম সংখ্যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২। এখানে গদ্য আছে ৫টা। গদ্যের চারটিই চলনবিল এবং চলনবিলের বিভিন্ন তথ্যকেন্দ্রীক। কবিতা যতগুলো আছে তার বেশিরভাগেই কোনো না কোনোভাবে চলনবিল উঠে এসেছে। চলনবিলকে নিয়ে তাঁদের আশা, হতাশা, আকাঙ্খা, উল্লাস স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। অবশ্য সারা বাংলাদেশের মানুষেরই চলনবিলকে নিয়ে একধরনের আগ্রহ আর উৎসাহ রয়েছে। এ সংখ্যার বেশিরভাগ লেখকই সম্ভবত চলনবিল এলাকার মানুষ।

দ্বিতীয় সংখ্যার দেহতরী আরো বেশি বড়, আরো বেশি উদার। এখানে পৃষ্ঠার পরিমান বেশি, লেখক-কবির পরিমান বেশি। আরো বেশি উন্নত। অনেকবেশি পূর্ণ। প্রায় সারাদেশের বিভিন্ন জেলার কবি-লেখকের অংশগ্রহন এখানে দেখা যাচ্ছে। প্রচুর কবিতা। তিনটি করে প্রবন্ধ আর গল্প। প্রবন্ধ এবারেও চলনবিল কেন্দ্রীক। ডেইজি আহমেদ এর গল্পটি চলনবিল এলাকার মানুষের জীবন-যাপনের গল্প। এ সংখ্যার পৃষ্ঠা ৪৮।

তৃতীয় সংখ্যা। হৃদয়ে চলন বিলের পৃষ্ঠা সংখ্যা এ সংখ্যাতে এসে কমেছে কিন্তু লেখার বৈচিত্র্য বেড়েছে। গদ্যগুলো পয়লা বৈশাখ নিয়ে লেখা। কবিতাগুলোর মানও বেশ উন্নত। গল্প আছে দুটি। দুটি গল্পই বেশ চমৎকার।

চতুর্থ সংখ্যা চার ফর্মার। প্রায় প্রত্যেকটি লেখার মানও বেশ উঁচু। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের পাশাপাশি নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ‘আলোচনা’ বিভাগ। অনেক তরুণ কবির সমাহার, মনটা জুড়িয়ে যায়। মোহাম্মদ নুরুল হকের প্রবন্ধটি যে কারোই ভালো লাগবে। চারটি গল্প আছে এ সংখ্যাতে।

পাঁচ ফর্মা ছাড়িয়ে গেছে পঞ্চম সংখ্যা। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, আলোচনা ছাড়াও ছড়া যোগ হয়েছে এবার। এবার যোগ হয়েছে মুক্তগদ্য আর চিঠি নামে দুটি নতুন বিভাগ। চিঠি উঠেই গেছে। চিঠি এখন বিলুপ্ত প্রজাতি। কিন্তু সম্পাদক ফিরিয়ে আনলেন চিঠি। এখানে চার তরুণীর চারটি চিঠি আছে। সকলের ভালো লেগেছে বলেই মনে হয়। এ সংখ্যাটি অনেক সুন্দর, অনেক পরিপূর্ণ।

হাদিউল হৃদয় বয়সে একেবারে তরুণ। তার প্রতিটি সম্পদকীয় তারুণ্যে, স্বপ্নে, উল্লাসে আর প্রতিশ্রুতিতে ভরা। সম্পাদকীয়গুলো পাঠও বেশ আনন্দ দেয়, নাড়া দেয়। আমার মনে হয় হাদিউল হৃদয় পত্রিকাটিকে তার ভালোবাসা, কর্মক্ষমতা, মানসিক শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে, আরো সামনে এগিয়ে নিতে পারবে। আমাদের সকলের উচিত তার সাথে থাকা।

পত্রিকাটিকে আমার আনন্দজল চঞ্চল চলনবিল মনে হয়েছে। পত্রিকাটিকে আমার কথা বলা বলনবিলের মত মনে হয়েছে।

হাদিউল হৃদয়সহ পত্রিকার সাথে যুক্ত সকলের প্রতি, সকল লেখক-কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।

চলনবিল চলতে থাকুক। বলনবিল বলতে থাকুক।

সর্বশেষ সংবাদ