রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত

শাফায়াত সজল, রংপুর থেকে ফিরেঃ তাজহাট রাজবাড়ি বা তাজহাট জমিদার বাড়ি রংপুর শহরের তাজহাটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। এটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে পর্যটকদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে ইতিমধ্যে বেশ নজর কেড়েছে। রাজবাড়িটি রংপুর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে নির্দিষ্ট দর্শনীর বিনিময়ে প্রবেশ করতে হয়। গ্রীষ্ম ও শীতকালে উক্ত স্থানে প্রবেশ এবং বন্ধের সময় সূচী আলাদা। এই জমিদারবাড়িকে ঘিরেও রয়েছে অনেক মজার গল্প।
জাদুঘরে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা গোপাল লাল রায় নির্মাণ করেন এই প্রাসাদটি। এতে সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। মহারাজা গোপাল লাল রায় ছিলেন হিন্দু এবং পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। তিনি সেইসময় প্রচলিত মাথায় পরহিত মুকুট বা টুপির ব্যবসা করতেন। কথিত আছে, তার বানানো মনমুগ্ধকর এই ”তাজ” বা ”মুকুট” এর কারণেই এলাকাটি তাজহাট নামে অভিহিত হয়ে আসছে। এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট বা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একটি বেঞ্চ হিসেবে। প্রেসিডেন্ট হুসাইন এরশাদ বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের আঞ্চলিক বেঞ্চ স্থাপন করেন যার একটি রংপুরে স্থাপিত হয়েছিল।
পরে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর এই পদ্ধতি তুলে দেয়া হয়। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকার এ স্থাপত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জাদুঘরকে স্থানান্তর করে এ প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসে। প্রবেশ টিকিট কেটে বিশাল ফুলের বাগান পার হয়ে চোখের সামনে পড়বে জমিদার বাড়ির ফুয়ারা।তার সামনে দিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কুরআন সহ মহাভারত ও রামায়ণ। আছে বেগম রোকেয়ার হাতে লেখা চিঠি।
পেছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটা কাল পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি। কিন্তু জাদুঘরের ভিতরে ছবি তোলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে বিশাল খালি মাঠ, গাছের সারি এবং প্রাসাদের দুই পাশে রয়েছে দুইটি পুকুর। প্রাসাদটি প্রায় ২১০ ফুটের মত প্রশস্ত ও চার তলার সমান উঁচু। এর গঠনশৈলী প্রাচীন মুঘল স্থাপত্য থেকে নেওয়া যার প্রমাণ মেলে মধ্যভাগে বিশাল একটি গম্বুজ ও দুই পাশে তার ছড়িয়ে যাওয়া দালানগুলোর একটা মসজিদের অবয়ব থেকে। তবে রাজবাড়ী যেই দিক থেকে বাংলাদেশের অন্য সকল প্রাসাদের থেকে আলাদা তা হল এর সিঁড়িগুলো। সর্বমোট ৩১ টি সিড়ি আছে যার প্রতিটাই ইতালীয় ঘরানার মার্বেল পাথরে তৈরি। সিঁড়ি থেকে উঠে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটাও একই পাথরে তৈরি।
রাজবাড়ির পিছনভাগে গুপ্ত সিঁড়ি রয়েছে। এই গুপ্ত সিঁড়ি কোন একটি সুড়ংগের সাথে যুক্ত যা সরাসরি ঘাঘট নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে এমন একটা জনশ্রুতি শোনা যায়। তবে সিঁড়ি টা এখন নিরাপত্তা জনিত কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাসাদের সুন্দর ফোয়ারাটি কালের বিবর্তনে শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কিছুটা মলিন হলেও এখনো এর জৌলুষ বুঝা যায়। লালমনিরহাট থেকে আসা গোলাম মোস্তফার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, “অনেক ভাল লাগলো দেখে, অনেক ইতিহাস জানতে পারলাম, তবে এটির মত সরকার যদি সব জমিদারবাড়ি গুলো মার্জিত করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয় তাহলে একদিকে যেমন রাজস্ব বাড়বে অপরদিকে আগত দর্শনার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে”।

সর্বশেষ সংবাদ