দেশের সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত আম বাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কাসসাট আম বাজার থেকে ফিরে মোঃ  হায়দার আলীঃ বাংলাদেশের আমের রাজধানীর নাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ,  ফলের রাজা আম। আর আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। দেশের সবচেয়ে বড় আম বাজার মানে কানসাট আমবাজার।  এখানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ কোটি  টাকার আমের বানিজ্য হয়ে থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত মোট আমের সিংহভাগই উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কৃষি বিভাগ জানায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ই উৎপাদিত হয় প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় সম্ভাবনা থাকার পরও বিদেশে পর্যাপ্ত আম রফতানি হচ্ছে না। অথচ এসব সমস্যার সমাধান করা হলে উৎপাদিত আম বিদেশে রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
 চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে বসে বাংলাদেশের বৃহত্তম আমের বাজার। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন যানবাহনে আম নিয়ে আসছে আম চাষিরা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা কিনছেন ইচ্ছ মত।
প্রতি আমের মৌসুমে দেশের এই বৃহৎ আম বাজারে ১২ কোটি টাকার উপরে আমের বেচাকেনা হয়। আমের সময়ে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমে থাকে এই আম বাজার। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক আমের বাজার থাকলেও কানসাট আমের বাজার পাইকারী বাজারের জন্যে সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত। এ যেন এক আমের রাজ্য। আম বাজার ঘুরে দেখার সাথে সাথে আপনি চাইলে কিনে খেতে পারবেন নানা রকম তরতাজা পাঁকা আম। এছাড়া ঝুড়িভর্তি করে আম কিনে নিতে পারবেন নিজের জন্যে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক চাঁপাই নবাবগঞ্জ সফরে এসে  বলেছেন, আমের বাণিজ্যিক উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এখন সরকার আমের রফতানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন, সরকার আমের উৎপাদন বাড়াতে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নত জাতের আম ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এখন সরকার আমের রফতানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে।
এ লক্ষ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সহ আম উৎপাদন এলাকায় ৪টি ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে আমের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি পাবে, রফতানি সহজতর হবে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
এ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কেন্দুয়া গ্রামে ফার্মিএগ্রো ফার্ম রফিকুল ইসলামের আম বাগানে আম চাষী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ তথ্য জানান, কৃষি মন্ত্রী ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তারের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন, কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ডক্টর শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, কৃষি সম্পসারন অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ডক্টর দেবাশীষ সরকার, জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস এমপি প্রমূখ। দমন্ত্রী আরও বলেন, আম চাষী ও উদ্যোক্তাদের মাত্র ৪ শতাংশ সুদের বিশেষ ঋণ ও আমবাগান করতে বিনামূল্যে উন্নত জাতের চারা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এছাড়া যেসব বাগানে আমের ফলন কম সেসব পুরাতন বাগান কেটে নতুন বাগান করতে চাইলে বিনামূল্যে উন্নত জাতের চারা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের আমকে আমরা ব্যাপকভাবে বিশ্ব বাজারে নিয়ে যেতে চাই। এক্ষেত্রে রফতানি বাঁধাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরলস কাজ চলছে। ইতিমধ্যে নিরাপদ আমের নিশ্চয়তা দিতে ৩টি ভ্যাকুয়াম হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বে আম উৎপাদনে সপ্তম স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশে আম রফতানি হলেও এর পরিমাণ উৎপাদনের তুলনায় অনেক কম।
আম বাংলাদেশের একটি উচ্চ মূল্যের অর্থকারী ফসল আর এর জন্য বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ আমের উন্নত জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে দেশে প্রতি বছর আমের উৎপাদন বাড়ছে।
বাংলাদেশে যেসব ফল উৎপন্ন হয় তার মধ্যে আমের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আমের নানাবিধ ব্যবহার, স্বাদণ্ডগন্ধ ও পুষ্টিমাণের জন্য এটি একটি আদর্শ ফল হিসেবে পরিচিত। তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু, আবহাওয়া সবই আমচাষের উপযোগী। দেশের প্রায় সব জেলায়ই আম ফলে। এমনকি উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে।
সুস্বাদু আমের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। আম বলতে রাজশাহীর আম তথা আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে বলা হয়। সুন্দর  সুস্বাদু, রং, আঁশবিভীন বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জুড়ি নাই।
রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন আম। যা দেশের সুস্বাদু আমের ৭০ ভাগ। বাণিজ্যের আশা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশে রফতানির টার্গেট আড়াই হাজার মেট্রিক টন।
সরবরাহ বাড়ায় বিগত বছরগুলোর মতো কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি বাগান মালিকরা। তবে বাড়তি ফলনের কারণে লাভের মুখ দেখছেন তারা। গত শুক্রবার বাজার ঘুরে দেখা যায়, আষাঢ়ের শেষ দিকেও জমজমাট রাজশাহীর বানেশ্বর আম বাজার। একই চিত্র নওগাঁর সাপাহার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কানসাট আম বাজারের। এদিন বানেশ্বর বাজারে মানভেদে প্রতিমণ আম রূপালী সর্বোচ্চ ২ হাজার ২শ’, ফজলি ১ হাজার ৪শ’, বারী ৪ দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ২০২১ সালে রাজশাহী জেলায় আমের আবাদ হয় ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে। ওই বছর মোট উৎপাদন আসে ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৩ মেট্রিকটন আম।
গত  বছর ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমির আমবাগানে আম উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৬ হাজার ১৫৬ মেট্রিকটন। আর চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে মোট ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫০ মেট্রিকটন।
অন্যদিকে, নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে আম রূপালী রাজশাহীর তুলনায় জাতভেদে গড়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গোদাগাড়ীর আম ব্যবসায়ী ইমাম আলী  জানান, শেষ সময়ে বাজারে আমের দর ভালো। দাম কিছুটা বাড়তি। আম বাগানি শামসুল বলেন, গেল বারের তুলনায় দাম কম। কিন্তু বাড়তি ফলনে লাভ হচ্ছে আগের মতোই।
বাগান মালিকদের দাবি, বিগত বছরগুলোর তুলনায় দাম কিছুটা কম হলেও উৎপাদন বেশি হওয়ায় আর্থিক দিক দিয়ে পুষিয়ে যাচ্ছে তাদের।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে আমের উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এতে লাভবান আম বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি বিভাগের হিসেব মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরের প্রায় ৯৩ হাজার হেক্টর জমির বাগানে সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি আম উৎপাদন হয়েছে। প্রথমবারের মতো আড়াই হাজার মেট্রিক টন আম রফতানির পাশাপাশি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের আশা তাদের।
তবে  চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষী আম ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমে ভরা মৌসুমে প্রচন্ড গরমে বিভিন্ন ধরণের আম এক সাথে পেঁকে গিয়েছিল,  ঈদ মৌসুমে আম পাঁকার কারনে আমের চহিদা কম থাকে মানুষের কুরবানির মাংশের প্রতি ঝোঁক বেশী থাকে ফলে উৎপাদিত আমের নায্য মূল্য পাচ্ছে  আম চাষিরা।
 সচেতন মহলের দাবী আম জোন এলাকায় কোল্ডষ্টোরেজ বা সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা করতে পারলে সরকার ও আমচাষী অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে।

সর্বশেষ সংবাদ