ভালো নেই মিন্নি

বরগুনায় রিফাত হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলায় প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে মুক্তি পেয়েছেন। চোখের সামনে খুনিদের নৃশংসতায় স্বামী হারানোর যন্ত্রণায় ভোগছেন এই তরুণী। শত চেষ্টা করেও সেদিন স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি, সেই দু:স্মৃতি সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে মিন্নির চোখের সামনে। স্বামী হত্যায় ফেঁসে গ্রেফতার, অত:পর পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নিপীড়ন, জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়। তদুপরি মাথার ওপর ঝুলছে মামলার খড়গ। সবমিলিয়ে ভালো নেই মিন্নি।

স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার পর মিন্নির এক মাস ১৮ দিন কেটেছে কারাগারে। মঙ্গলবার বাসায় ফিরে চুপচাপ হয়ে গেছেন মিন্নি। ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকছেন স্বজনদের দিকে। কিছুই বলছেন না। চাপা কষ্ট ভর করে আছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসছে পানি।

আক্ষেপ করে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর বলেন, ‘একদিকে স্বামী হারানোর শোক, অপরদিকে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা- সব মিলিয়ে ভালো নেই মিন্নি।’ তিনি বলেন, মেয়েটার ওপর পুলিশ হেফাজতে নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়েছে। তার হাটুতে আঘাত করা হয়েছে প্রচণ্ডভাবে।

হাইকোর্টের দেয়া জামিনের শর্তে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো বক্তব্য না দিলেও মিন্নি তার ওপর চালানো পুলিশের অমানুষিক নির্যাতনের কথা বাবাকে জানিয়েছেন।

মিন্নির বাবা কিশোর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মিন্নি পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তার হাঁটুতে আঘাত করা হয়েছে। সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। যার কারণে তাকে কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাসায় আনা হয়েছে।’

উন্নত চিকিৎসার জন্য মিন্নিকে ঢাকা অথবা বরিশালে নিয়ে যাবেন জানিয়ে তার বাবা বলেন, ‘বাসা থেকে যখন সাক্ষী হিসেবে মিন্নিকে প্রথমে পুলিশ লাইনে আসামি শনাক্তকরণের কথা বলে নেয়া হয় সেই থেকেই চলে নির্যাতন।

মিন্নিতে পুলিশ হেফাজতে ঘুমাতে দেয়া হয়নি জানিয়ে কিশোর বলেন, আদালতে তোলার আগের রাতে মিন্নিকে ঘুমাতে দেয়া হয়নি। সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও দেয়া হয়নি।’

এর আগে মঙ্গলবার বিকালে কারাগারে জামিন আদেশ পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকাকালে কারাফটকে কিশোর যুগান্তরকে বলেন, আমার মেয়ে ছিল সাক্ষী। একটি প্রভাবশালী মহলের কারণে তাকে আসামি করা হয়েছে। আমার মেয়ে তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন সন্ত্রাসীদের সামনে পড়েছে। অথচ তাকে আসামি করে দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখা হলো।

কুচক্রী মহলের কারা জানতে চাইলে মিন্নির বাবা বলেন, ‘যারা বরগুনায় নয়ন বন্ড তৈরি করেছে, ইয়াবা মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, যে প্রভাবশালী মহলের নাম ইতিপূর্বে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তারাই আমার মেয়েকে সাক্ষী থেকে আসামির কাঠগড়ায় এনেছে। এমনকি মিন্নিকে ঢাকা থেকে যেন জামিন করাতে না পারি, সে জন্য সেই কুচক্রী মহল তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল।’

বরগুনা সরকারি কলেজগেটের সামনে ২৬ জুন সকালে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও তার সঙ্গীরা রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে। বিকালে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।

পর দিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ১৬ জুলাই মিন্নিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তা শেষ হওয়ার আগেই ১৯ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা মিন্নিকে বরগুনা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করেন।

মিন্নি হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২১ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিন্নির আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করেন আদালত। ২৩ জুলাই তার আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন।

৩০ জুলাই তা নামঞ্জুর হলে ওই আদেশের বিরুদ্ধে ৬ আগস্ট হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী। ৮ আগস্ট হাইকোর্ট রুল দিতে চাইলে মিন্নির আইনজীবী আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। পরে হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চে আবেদন করেন আইনজীবী।

এর আগে গত ২৯ আগস্ট মিন্নিকে কেন জামিন দেয়া হবে না- মর্মে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুই শর্ত দিয়ে মিন্নির অন্তর্বর্তী স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করে রায় দেন।

শর্ত দুটি হলো- ১. জামিনে থাকাবস্থায় মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন; ২. জামিনে থাকাবস্থায় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। এই দুই শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে মিন্নির জামিন বাতিল হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।

এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের দেয়া জামিন স্থগিত চেয়ে করা রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের ওপর সোমবার নো-অর্ডার (কোনো আদেশ নয়) দেন সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালত। ফলে মিন্নির জামিনে মুক্তিতে বাধা কাটে।

সর্বশেষ সংবাদ