টাকা ছাড়া মিলেনা ভিজিডি কার্ড

জেলা প্রতিনিধি, লালমনিরহাট-বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ কর্মসূচি অসহায় ও দুস্থ নারীদের জন্য ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বিনামূল্যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও লালমনিরহাটের আদিতমারীতে মোটা অংকের টাকা ছাড়া কোনভাবেই মিলছেনা এই সেবা। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, গ্রাম পুলিশ, সচিবসহ সিন্ডিকেট করে টাকার বিনিময়ে এসব কার্ড সরবরাহ করছেন অসহায় নারীদের মাঝে। উলটা অনেকেই টাকা দিয়েও কার্ড না পাওয়ায় ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সিন্ডিকেটের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ইউপি সদস্য ও সচিব দ্বন্দে জড়ানোর পর বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। তদন্ত কর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান প্রশাসন।
সরেজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়,
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৩৮৭টি ভিজিডি কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৪ নং সারপুুকুর ইউনিয়ন পরিষদে দুঃস্থদের মাঝে ৩৩৪টি ভিজিডি কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়। অসহায় ও দুস্থদের অনলাইনে আবেদন ও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে এসব বরাদ্দ দেওয়া হলেও সারপুকুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী ও সচিব সাইফুল ইসলাম সিন্ডিকেট করে কার্ড বাবদ চার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। টাকা না দিলে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে আবেদন বাতিল করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট লোক ও কয়েকজন গ্রাম পুলিশের হাতে টাকা দিলেই মিলেছে এসব কার্ড। অনেকেই টাকা দিলেও কার্ড না পাওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত ঘুরছেন। কিন্তু কোন সমাধান পাচ্ছেন না।
এসব টাকা ও কার্ড ভাগাভাগি নিয়ে ওই প্যানেল চেয়ারম্যান ও সচিবের সম্প্রতি দ্বন্দের সৃষ্টি হলে সচিবের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্ড নিজের কাছে রাখার অভিযোগ তুলেন প্যানেল চেয়ারম্যান।  পরে সরেজমিনে উভয়ের এই অনিয়ম উঠে আসে।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম অভিযোগ করেন, তার ভাতিজীর ভিজিডি কার্ডের জন্য ওই ওয়ার্ডের রবিউল মিয়াকে ৫ হাজার টাকা দেন। কিন্তু অনেকের কার্ড হলেও তার কার্ড এখনো হয়নাই। তাই ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছেন তিনি।
৬ নং ওয়ার্ডের নুরুজ্জামাল মিয়া বলেন, আমি দিনমজুর মানুষ। খেটে খাই।  আমার কাছে ভিজিডি কার্ড বাবদ শাহাজান মেম্বারকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু আমাকে কার্ড দেয়নাই। ‘এখানকার মেম্বার চেয়ারম্যান সগায় চোর, কার্ড বিক্রি করি খায়, স্লিপ বিক্রি করি খায়।’
রুজিনা নামে এক নারীর অভিযোগ,  শাজাহান মেম্বারের মাধ্যমে অনলাইন করেছি। নাম আসায় কার্ডে সাইন ও দিয়েছি। কিন্তু কার্ড না দিয়ে তাকে ঘুরাচ্ছে। কেন ঘুরাচ্ছে জানিনা।
৪ নং ওয়ার্ডের আব্দুল কাদের বলেন, আমার বোনের কার্ডের জন্য চার হাজার টাকা দিয়েছিলাম। ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বারাকাত আলী টাকা নেওয়ার পর মাস খানেক আগে কার্ড করে দিসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানান, মেম্বার, সচিব সিন্ডিকেট করে টাকা নিয়ে কার্ড দিচ্ছে। এখন ভাগাভাগি নিয়ে তাদেরই দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ওদের ভয়ে আমরা কেউ কথা বলতে পারিনা। প্রশাসনের কাছে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবীও জানান তারা।
এমনই নানা ব্যাক্তি ইউনিয়ন পরিষদের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছেন টাকা দিয়ে কার্ড নেওয়ার জন্য। বরাদ্দকৃত লোকের চেয়েও বেশি লোকের থেকে টাকা নেওয়ায় অনেকেই কার্ড পাননি। এ নিয়েই মূলত জটিলতা তৈরি হয়েছে। পরে কার্ড ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ শুরু হয় ইউপি সচিব সাইফুল ইসলাম ও প্যানেল চেয়ারম্যান শাজাহান আলীর মধ্যে।
পরে এ নিয়ে শাজাহান আলী ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দিয়ে সচিবের বিরুদ্ধে ১৩৪ টি কার্ড ক্ষমতা দেখিয়ে নিজের আয়ত্তে রাখার অভিযোগ তোলেন। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন জনের নামের এসব কার্ড বরাদ্দ করার কথা বলেন ওই সচিব। যেটা সম্পুর্ন অন্যায়।
সারপুুকুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী বলেন, প্রশাসন ও জনপ্রনিধির নাম ভাঙ্গিয়ে ১৩৪টি ভিজিডি কার্ড সচিব নিলেও এসব কার্ড তিনি কাউকে দেননি। তিনি দাবী করে বলেন, মহিলা বিষয়ক অফিসের এক কর্মচারীর সহায়তায় প্রতিটি ভিজিডি কার্ড থেকে ৬/৭ হাজার টাকার বিনিময়ে এসব নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন সচিব। কিন্তু তার বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে কার্ড দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি।
বিষয়টি নিয়ে সারপুুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম হুমায়ুন কবির ঢাকামেইলকে বলেন, সচিব সাহেব ১৭ টি কার্ড মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সুপারিশে রেখেছিলেন। তা আমাকে দিয়েছেন। আমি উপজেলায় গিয়ে বিষয়টি যাচাই করে সত্যতা না পেলে লিখিত অভিযোগ করবো। সচিব কোনভাবেই তার কাছে কার্ড রাখতে পারেনা।
অভিযোগের বিষয়ে সারপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সাইফুল ইসলাম ঢাকামেইলকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে প্যানেল চেয়ারম্যান মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তুলেছে। আমি কোন কার্ড রাখিনাই।
তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা  নিচ্ছেন না কেন এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি তিনি।
এছাড়াও ভিজিডির বরাদ্দ নিয়েও মনগড়া তথ্য দেন তিনি যার কোন মিল পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জি আর সারোয়ার ঢাকামেইলকে বলেন, বিষয়টি শুনেছি। অর্থের বিনিময়ে ভিজিডি কার্ড দেওয়ার কোন নিয়ম নাই। কেউ এটা করলে তদন্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সার্বিক বিষয়ে লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ঢাকামেইলকে বলেন, আমার কাছে এখনো কোন অভিযোগ আসেনাই। অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে অভিযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

সর্বশেষ সংবাদ